হাজিদের করণীয় কাজসমূহ ও নবীজির স্মৃতিবিজড়িত স্থান
া মাহমুদুল হক জালীস
প্রতিটি মানুষের দৈহিক-আর্থিক সামর্থ্য এবং স্থান ও সময়গত সামঞ্জস্যতার জন্য বিশ্বজনীন ইবাদত হজ। ইসলাম ধর্মের অন্যতম বিধান। হজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাযিল করেছেন। বলে দিয়েছেন হজের নিয়ম-নীতি। কর্মতৎপরতায় হজ পৃথিবীর লক্ষ জনতার চলমান মহাসমাবেশ। পৃথিবীর সকল স্থান থেকে অগনীত বনী আদম এখানে সমবেত হন। যাদের পরনের কাপড় এক, কামনা এক, মনে-মুখে ধ্বনিত হয় একই ভাষার একই উচ্চারণ-লাব্বাইক! আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! (উপস্থিত! হে প্রভু আমি উপস্থিত!!) আরাফাত, মুজ্দালিফা, মিনা প্রভৃতি স্থানে যথা সময়ে সুশৃঙ্খল কর্ম সম্পাদনের এক মহা প্রশিক্ষণ হল হজ। হজের ফরজ তিনটি। যথা: ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ এ জিয়ারত করা। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়া।
এ ফরজগুলোর একটি ছুটে গেলেই হজ নষ্ট হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে তা কাযা করাও ফরজ। তাই যথাযথভাবে হজের ফরজগুলো সুসম্পন্ন করবার সার্বিক প্রস্তুতি প্রতিটি হাজির জন্য জরুরি। হজ একটি পুণ্যময় ইবাদত। যা ত্রুটি মুক্তভাবে সম্পন্ন করতে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া একান্ত জরুরি। কেননা, প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “কবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়” (সহীহ বুখারি) কাজেই, মহান আল্লাহর ঘরের মেহমান হাজি সাহেবানকে নিচের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ যত্মবান হতে হবে। ১. হজের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ২. তাওবার মাধ্যমে মানসিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। ৩. আর্থিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পাপমুক্ত হতে হবে ৪. দৃঢ় মনোবল ও সুস্থ থাকতে হবে। ৫. নিয়ম কানুন দোয়া-কালাম শিখে ও লিখে নিতে হবে, ‘ক্ষুদ্র পুস্তিকা’ সঙ্গে রাখলে ভালো। ৬. নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী হালকা ও পরিমিত পরিমাণ হওয়া। ৭. রোগকে অবহেলা ও আড়াল না করা। ৮. নিজে ও সব কিছু হারালেও মনোবল না হারানো। ৯. শরীর, সময় ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ইবাদত করা। ১০. হজের ফরজ ও ওয়াজিব পালনে বিশেষ যতœবান বান হওয়া। ১১. সবসময় অন্যের সুবিধা বিবেচনায় রাখা। ১২. অন্যকে কষ্ট না দেওয়া কেননা, তা হারাম। ১৩. ইহরাম না বেঁধে ‘মিকাত’ বা সীমা অতিক্রম না করা। ১৪. হাজরে আসওয়াদ চুম্বনে ভিড়, ধৈর্যচ্যুতি ও ধাক্কাধাক্কি পরিহার করা। এবং ১৫. আরাফাতের সীমানার বাইরে না থেকে গন্ডির মধ্যে অবশ্যই সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা। মহান আল্লাহর ঘরের মেহমানগণের সৌভাগ্য যে, তাঁরা মক্কা মদিনার পবিত্র স্থানগুলো দেখার সুযোগ পাবেন। এ প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করবো। মক্কা মদিনায় দর্শনীয় পবিত্র স্থানগুলো প্রিয়নবীর (সা.) স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজো সুসংরক্ষিত এবং নবীজি (সা.) চলমান মু’জিজা। যেমন মসজিদুল হারামের আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে ‘সুক-আল-লাইল্’ মহল্লার ‘আব্দুল মুত্তালিবে’র বাড়ি যেখানে দু’জাহানের বাদশাহ্ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তা একটি দর্শনীয় স্থান। হালিমা সাদিয়ার (রা.) বাড়ি বনু সাআদ গোত্রের একটি সাধারণ বাড়ি ও এর কাছের একটি কূপ প্রিয়নবীর (সা.) স্মৃতিধন্য। কেননা, সেখানে দুধবোন সায়মার সেবায় তাঁর কেটে ছিল ছয়টি বছর। হালিমা সাদিয়ার (রা.) সৌভাগ্য যে তিনি বিশ্বনবীকে (সা.) স্তন্যদান করেছিলেন। আর ‘রাহমাতুল লিল্ আ’লামিনে’র শুভাগমনে ধূসর ও মৃতপ্রায় খেজুর বাগানে জেগেছিল সবুজের সমারোহ। মক্কার কাবা ঘরের অদূরে অবস্থিত ‘জাবালে নুর’ যা হেরা পর্বত হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এখানেই পবিত্র কুরআন নাযিলের শুভ সূচনা হয়। সর্বপ্রথম সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় এখানেই। জিবরাইল আমিন প্রিয়নবীকে বলেন “পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে…” ( আয়াত: ০১)। প্রিয়নবীর (সা.) স্মৃতিবিজড়িত অনেক মসজিদ রয়েছে- মসজিদে কোবা, মসজিদে নব্বী, মসজিদে কিবলাতাইন, মসজিদে জুম’আ, মসজিদে জ্বীন, ইত্যাদি। মদিনা থেকে তিন মাইল দূরের আলিয়া বা কোবায় প্রিয়নবী (সা.) কে স্বাগত জানান আমর ইবনু আউফ গোত্রের প্রধান কুলসুম ইবনু হাদাম (রা.)। মদিনায় প্রবেশের আগে প্রিয়নবী (সা.) এখানে চৌদ্দ দিন অবস্থান করেছিলেন। এখানে প্রিয়নবী (সা.) একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এই ‘মসজিদে কোবা’ হলো প্রিয়নবীর (সা.) তৈরি প্রথম মসজিদ। এই মসজিদের প্রশংসায় মহান আল্লাহ্ বলেন “যে মসজিদের ভিত্তি রাখা হয়েছে তাকওয়ার (ধর্মভীরুতা) ওপর…”(তওবা: ১০৮)। প্রিয়নবীর (সা.) শ্রেষ্ঠতম স্মৃতিচিহ্ন তাঁর ‘রওজাতুল আতহার’ বা ‘পবিত্র সমাধি’। উম্মতে মুহাম্মদীর সর্বকালীন সর্বাত্মক ঐক্যমত হলো ‘বায়তুল্লাহ’র পর দুনিয়ার বুকে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ স্থান হলো ‘রওজাতুল আতহার’ বা ‘পবিত্র সমাধি’। ভক্তিবাদী মানুষের আকাংক্ষায় থাকে জীবনে একটিবারের জন্য হলেও যেন ‘রওজা শরিফ’ জিয়ারতে বলতে পারেন: ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’। কারণ, প্রিয়নবী (সা.) নিজে বলেছেন “যে আমার কবর জিয়ারত করবে তার জন্য শাফাআ’ত করা আমার কর্তব্য হয়ে যায়”। পরিশেষে মুনাজাত, মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মক্কা মদিনার পবিত্র দর্শনীয় স্থান জীবনে একবার হলেও দেখবার তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ্ হাজী সাহেবানকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখুন সবাইকে হজ করবার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা দান করুন । আমিন। /লেখক : সম্পাদক, আল্পনা