হজের ফাজায়েল ও মাসায়েল
া মোস্তফা কামাল গাজী
হজ ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোর অন্যতম। হজের মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। এটি আর্থিক ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ইবাদতও। তাই মুসলমানের জন্য হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হজকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঘটে অপূর্ব মেলবন্ধন। পবিত্র কাবা ঘরের চারপাশে শুভ্র সফেদ আল্লাহপ্রেমীদের মনে হয় ফেরেশতাদের কোনো মিলনমেলা। মুমিন বান্দারা তখন পরস্পর হয়ে যান ভাই ভাই। একে অপরের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ আর সহানুভূতির সেতুবন্ধন।
হজের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা, সঙ্কল্প করা। শরিয়তের পরিভাষায় হজ বলা হয় নির্দিষ্ট মাসে বিশেষ কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানের জিয়ারত করা। হজ একটি ফরজ ইবাদত। নামাজ, রোজা, জাকাত যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য হজ একটি অন্যতম বরকতপূর্ণ ইবাদত। হজ মুসলমানদের দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানের আসন দান করে এবং সৌভাগ্যের দরজা খুলে দেয়।
হজের গুরুত্ব ও ফজিতের কথা অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তুমি হাজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন তুমি তাকে সালাম করবে, মুসাফাহা করবে এবং তার বাড়িতে প্রবেশের আগে তাকে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধ করবে। কেননা তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত।’ (আহমদ: ২৫৩৮)
একইভাবে মাকবুল হাজিদের জন্য আখিরাতে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কারের সুসংবাদ। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায় কার্যাদি থেকে বিরত হয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ আদায় করবে, সে যেনো মায়ের গর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফেরে’। (বোখারি: ১৪৪৯) তিনি আরো এরশাদ করেছেন, ‘জান্নাতই হচ্ছে একমাত্র মাকবুল হজের পুরস্কার’। (মুসলিম: ৫৭৪৫) হজের পুরস্কারের কথা উল্লেখ করে অন্য হাদিসে নবি করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘হজের ভ্রমণে খচর করা এত বড় নেকির কাজ যেনো তা জিহাদে খরচ করা হলো। এক টাকা খরচ করলে সাতশ টাকা খরচ করার পুণ্য লাভ হয়। (বায়হাকি: ৬৭৩) হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার তিনি নবি করিম (সা.) এর কাছে উমরাহর অনুমতি চাইলেন। নবী করিম (সা.) তাকে উমরাহতে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, ‘প্রিয় ভাই! আপনার বিশেষ দোয়ার মধ্যে আমাকেও শরিক করবেন এবং দোয়ার মধ্যে আমাকে ভুলবেন না।’ (মুসলিম: ৮৬৫৭) আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো লোক পবিত্র মাল নিয়ে হজের জন্য বের হয়ে নিজ বাহনের পাদানিতে পা রেখে ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক’ ধ্বনি দিয়ে তালবিয়া পড়তে থাকে, তখন আসমান থেকে এক ফেরেশতা বলে, ‘লাব্বায়কা ও সাআ’দায়ক’ (তোমার জন্যই উপস্থিতি ও সৌভাগ্য!) আর যখন হারাম মাল দ্বারা হজের জন্য ঘর থেকে বের হয় এবং বাহনের পাদানিতে পা রেখে ‘লাব্বায়কা’ বলে তখন আসমান থেকে এক ফেরেশতা ডেকে বলে, ‘লা লাব্বায়কা ওয়ালা ছাআ’দায়ক’ (তোমার জন্য উপস্থিতি ও কোনো কল্যাণ নেই)। (আবু দাউদ: ৭৮৪৪)
মুমিন মাত্রই পবিত্র হজ ও উমরা পালনের জন্য পবিত্র খানায়ে কাবার জিয়ারত, পুণ্যভূমি আরবের বিভিন্ন বরকতময় স্থান পরিদর্শন এবং মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র রওজা শরিফে সালাম প্রদানের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা মনে পোষণ করেন। আর গরিব মুসলমান আজীবন হজের স্বপ্ন নিয়ে নামাজ কালামে পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া করতে থাকেন। সামর্থ্যবানরা বারবার হজ ও উমরা করেন; আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন ও নবী করিম (সা.) এর মুহাব্বতে। বারবার হজ নসিব হওয়াও আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর মাধ্যমে হজের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যে যতবার সে ডাকে ‘লাব্বায়েক’ বলেছে, জীবনে ততবার তার হজ নসিব হবে। অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি যে বান্দাকে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা দান করেছি, অর্থ ও পুঁজিতে প্রশস্ততা দিয়েছি আর এভাবে পাঁচটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল যে, সে ব্যক্তি এর মধ্যে একবারও আমার ঘরে হাজিরা দিল না, নিশ্চিতভাবে সেই ব্যক্তি আমার রহমত থেকে বঞ্চিত থাকবে।’ (মেশকাত: ৬৮৪৬) বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, হজ যখন ওয়াজিব হয় তখনই পালন করা এবং একবারই পালন করা ফরজ। তাই প্রত্যেক স্বাবলম্বী ও সুস্থ মুমিনের উচিৎ, দেরি না করে যথাসময়ে হজ আদায় করা।
হজের কিছু বিধিবিধান : হজের মাস চারটি। শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের দশ দিন। হজ ফরজ হওয়ার শর্ত আটটি : ১. মুসলমান হওয়া, ২. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, ৩. বালেগ হওয়া, ৪. স্বাধীন হওয়া, ৫. হজের সময় হওয়া, ৬. মধ্যম ধরনের ব্যয় হিসেবে সফরের ব্যয় বহনের সামর্থ্য থাকা, যদিও হজ পালনকারী মক্কা শরিফে অবস্থান করে। ৭. যারা মক্কা শরিফের বাইরে থাকেন তাদের জন্য হজ পালনের শর্ত হলো মালিকানা বা ভাড়া সূত্রে স্বতন্ত্রভাবে একটি বাহন বা অন্য কিছু ব্যবহারের সামর্থ্য থাকা যেমন, আমাদের দেশের হাজীরা বিমান ব্যবহার করে থাকেন। ৮. অমুসলিম দেশে মুসলমান ব্যক্তির ‘হজ ইসলামের একটি রুকন’ এ কথা জানা থাকা।
হজ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাঁচটি : ১. সুস্থ থাকা, ২. হজে যাওয়ার বাহ্যিক বাধা না থাকা, ৩. রাস্তা নিরাপদ হওয়া, ৪. মহিলারা নিজ ইদ্দত অবস্থায় না থাকা, ৫. নারীর সঙ্গে একজন মুসলমান আস্থাভাজন, জ্ঞানসম্পন্ন, বালেগ মাহরাম পুরুষ থাকা। হজের রুকন দুটি। ১. ইহরাম বাঁধা। ২. মুসলমান হওয়া। হজের ওয়াজিবসমূহ : ১. মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধা, ২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা, ৩. জিলহজের দশ তারিখে ফজরের সময় শুরু হওয়ার পর এবং সূর্যোদয়ের আগে মুজদালিফায় থাকা, ৪. পাথর নিক্ষেপ করা, ৫. হজে কেরান ও হজে তামাত্তু পালনকারীর পশু জবেহ করা, ৬. মাথা মু-ানো বা চুল ছোট করা, ৭. মাথা মু-ানোর কাজটি হারাম শরিফে এবং কোরবানির দিনগুলোতে সম্পন্ন করা, ৮. মাথা মু-ানোর আগে পাথর নিক্ষেপ করা, ৯. হজে কেরান ও হজে তামাত্তু পালনকারীর পাথর নিক্ষেপ ও মাথা মু-ানোর মধ্যবর্তী সময়ে পশু জবাই করা, ১০. কোরবানির দিনগুলোতে তাওয়াফে জিয়ারত সম্পন্ন করা, ১১. হজের মাসগুলোতে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সায়ি করা, ১২. গ্রহণযোগ্য তাওয়াফের পর সায়ি করা, ১৩. ওজর না থাকলে হেঁটে সায়ি করা, ১৪. সাফা থেকে সায়ি আরম্ভ করা, ১৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা, ১৬. বায়তুল্লাহ শরিফের সব ক’টি তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে শুরু করা, ১৭. ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করা, (১৮) ওজর ছাড়া হেঁটে তাওয়াফ করা, ১৯. ছোট-বড় উভয় হদস (নাপাকি) থেকে পবিত্র থাকা, ২০. সতর ঢাকা, ২১. তাওয়াফে জিয়ারতের বেশির ভাগ চক্কর সম্পন্ন করার পর অবশিষ্ট চক্করগুলো সম্পন্ন করা
২২. নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা যেমন : পুরুষরা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা এবং মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখা এবং মহিলারা চেহারা ঢাকা। এছাড়া যৌন উত্তেজক কথাবার্তা বলা, গুনাহের করা, ঝগড়া-বিবাদ করা, শিকার বা শিকারের প্রতি ইশারা করা কাউকে শিকার দেখিয়ে দেয়া ইত্যাদি কাজ সবার জন্য নিষেধ।
হজের প্রকারভেদ : হজ মোট তিন প্রকার। যথা ১. ইফরাদ ২. তামাত্তু ৩. কেরান। হজে ইফরাদের পরিচয় : ইফরাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ, একা, একাকি বা পৃথক। শরিয়তের পরিভাষায় মিকাত থেকে হজের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে শুধু হজ সম্পন্ন করার নাম ইফরাদ।
হজে তামাত্তুর পরিচয় : তামাত্তুর আভিধানিক অর্থ, উপকারিতা অর্জন করা, উপভোগ করা। পরিভাষায় মিকাত থেকে প্রথমে ওমরার ইহরাম বেঁধে তার কার্যাবলি সমাপন করে হালাল হওয়ার পর হজের সময় হজের ইহরাম বেঁধে তার আহকামগুলো সম্পাদন করাকে তামাত্তু বলে। হজে কেরানের পরিচয় : কেরানের শাব্দিক অর্থ : মেলানো, মিশ্রণ করা। পরিভাষায় মিকাত থেকে একসঙ্গে হজ ও ওমরার নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে উভয়টিকে একই ইহরামে সমাপ্ত করাকে কেরান বলে। কেরান হজের প্রথম কাজ : কেরানের মধ্যে সর্বপ্রথম ওমরার কাজ সম্পন্ন করে দিতে হবে, তারপর হজের কাজ শুরু করতে হবে। এ কারণে কোনো ব্যক্তি প্রথমে হজের নিয়তে তাওয়াফ করলেও ওমরাহর তাওয়াফই হবে। কেরানকারীর কোরবানির বিধান : কেরানকারীরা কোরবানির দিনে হজ ও ওমরাহ উভয়ের জন্য কোরবানি করবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে একই সময়ে একই ইহরামে হজ ও ওমরাহ দু’টিই আদায় করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই আল্লাহর শুকরিয়া হিসেবে তার ওপর একটি কোরবানি ওয়াজিব হবে। আর যদি কোরবানির সামর্থ্য না থাকে তাহলে ১০টি রোজা রাখতে হবে। এগুলোর মধ্যে তিনটি হজের দিনগুলো তথা ৭, ৮ ও ৯ তারিখে রাখতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ব্যক্তি কোরবানি দিতে অক্ষম হবে সে হজের সময় তিন দিন রোজা রাখবে আর যখন তোমরা হজ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে তখন আরো সাতটি রোজা রাখবে।’
কেরান নিয়তকারী ওমরা ছেড়ে দিলে তার হুকুম : কেরান পালনকারী যদি মক্কায় প্রবেশ না করে সোজা আরাফায় চলে যায় তাহলে তার ওমরা বাতিল ও মুফরিদ হিসেবে গণ্য হবে। এ ওমরা ছেড়ে দেয়ার কারণে তার ওপর একটি দম ও কাজা ওয়াজিব হবে। কেননা সে নিয়তের মাধ্যমে তার ওপর ওয়াজিব করে নিয়েছিল। আর ওয়াজিব পরিত্যাগের জন্য কাজা ওয়াজিব হয়েছে। আর যদি মক্কায় প্রবেশ করে ওমরার বেশির ভাগ কাজ করার আগেই আরাফায় চলে আসে তাহলেও উক্ত হুকুম প্রযোজ্য হবে। হজে তামাত্তুর বিধান : তামাত্তুকারী তাওয়াফের সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দেবে। মহানবি (স.) থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে। দমের হুকুম : তামাত্তু আদায়কারীর ওপর শুকরিয়াস্বরূপ কিরান আদায়কারীর মতো একটি কোরবানি করা ওয়াজিব। যদি সে কোরবানি করতে অক্ষম হয় তাহলে কোরবানির দিনের আগে তিনটি এবং বাকি সাতটি রোজা পরে রাখতে হবে। উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা হজের গুরুত্ব, ফাজায়েল ও মাসায়েল বুঝে আসলো। প্রত্যেক ধনী ও সুস্থ মুমিনের উচিৎ যথাসময়ে হজ আদায় করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। আর গরিবদের উচিৎ হজের প্রতি মনের গহীন থেকে প্রেমবোধ উপলব্ধি করা এবং হজে যাওয়ার জন্য দোয়া করা।