হজ মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক
া মাহফুজ আল মাদানী
হজ। নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট কাজের ইচ্ছা পোষণ করার নাম। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে হজের ঘোষণা দিয়ে বলেন, যে লোকের সামর্থ আছে তার উপর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য। (সুরা আলে ইমরান ঃ ৯৭)
ইসলাম যে পাচঁটি বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে অন্যতম হলো এটি। যা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মিলন। পৃথিবীর মধ্যে এর চেয়ে বড় সম্মেলন কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। যা প্রতিবছর হজকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। এ সম্মেলনের জন্য কাউকে কোন দাওয়াতনামা বা চিঠি কোনভাবেই আহ্বান করতে হয় না। বরং আল্লাহ পাকের আহ্বানে সবাই সমবেত হয় কাবার প্রাঙ্গনে, আরাফাতের প্রান্তরে, মুজদালিফার খোলা আকাশের নিচে আর মিনার তাবুতে।
মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা, মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার কর। তারা আমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর দূরান্ত থেকে। (সুরা আল হজ ঃ ২৭) আর তারই আহ্বানে বিশ্ব মুসলমানরা আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি উপস্থিত আপনার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা, নেয়ামতরাজি ও রাজত্ব আপনারই। আপনার কোন শরীক নেই এই ঘোষণা দিতে দিতে উপস্থিত হন রবের ডাকে সাড়া দেয়ার নিমিত্তে আরবের ঐ মরু প্রান্তরে, কাবার ধারে, আরাফার সর্ববৃহৎ সম্মিলনে।
এই পবিত্র জনসমাবেশের কাজ শুরু হয় সাদা দু’টুকরো কাপড় পরিধান করে তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বেঁধে। এই ইহরাম বা হজের নিয়তের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট স্থান। যেগুলোকে মীকাত বলা হয়। এই মীকাত সমূহের যে কোন একটিতে হজ বা ওমরাহ এর ইহরাম বাধঁতে হয়। মীকাতসমূহ হলো, যুল হুলাইফা, যা মদীনাবাসী এবং ঐ পথ দিয়ে মক্কায় আগমনকারীদের মীকাত। জুহফা, এটি সিরিয়াবাসী ও ঐ পথে মক্কায় আগমনকারীদের মীকাত। যাতে ইরক, এটি ইরাকবাসী এবং ঐ পথে মক্কায় আগন্তুকদের মীকাত। কারনুল মানাজিল, নজদবাসী এবং নজদের পথে মক্কায় আগমনকারীদের জন্য। ইয়ালামলাম হলো ইয়েমেনবাসী ও তৎপথে মক্কায় গমনকারীদের মীকাত। যারা মক্কার বাহিরে কিন্তু মীকাতের ভিতরে অবস্থিত তাদের মীকাত হলো হিল। আল হারাম মক্কাবাসীদের মীকাত। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ হতে গমনকারী হাজীদের মীকাত হলো ইয়ালামলাম।
হজের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। প্রত্যেকটির মর্যাদাও আলাদা। প্রথমটি হলো হজ্জে ক্বিরান। মীকাত হতে হজ এবং ওমরাহ এর জন্য একই নিয়াতে একসাথে ইহরাম বাধাকে হজ্জে ক্বিরান বলে। দ্বিতীয় প্রকারটি হজ্জে তামাত্তো। মীকাত থেকে প্রথমে ওমরাহর নিয়াত করে ওমরাহর কাজ সম্পাদন করে হালাল হয়ে ৮ই জিলহজ হজের নিয়াত করে হজের কাজ সম্পন্ন করার নাম হজ্জে তামাত্তো। তৃতীয় হজ্জে ইফরাদ। মীকাত থেকে শুধু হজের জন্য ইহরাম বাধাকে হজ্জে ইফরাদ বলে। হানাফী মাযহাব অনুসারে সর্বোত্তম হজ হলো হজ্জে ক্বিরান, তারপর হজ্জে তামাত্তো, তারপর হজ্জে ইফরাদ। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজকে কেন্দ্র করে সম্মানীত এ ধর্মের বিভিন্ন নিদর্শন স্পটে বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয়। তাইতো হজের রয়েছে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতসমূহ। ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, হজের ফরজ তিনটি। ইহরাম বাধাঁ, আরাফায় অবস্থান করা ও তাওয়াফে জিয়ারত করা। শুধু সেলাইবিহীন সাদা দু’টুকরো কাপড় পরিধান করার নাম ইহরাম নয়। বরং ঐ কাপড় পরিধান করে দুই রাকাত নামাজ আদায়ান্তে হজ বা ওমরাহর নিয়াত করে তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে কার্যাবলী সম্পাদনের ইচ্ছাপোষণ করাই ইহরাম। যে ইহরাম বাঁেধ তাকে মুহরীম বলে। হজের অন্যতম কাজ হলো আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৯ই জিলহজ আরাফার ময়দানে অবস্থান ব্যতিরেখে হজ আদায় হবে না। তাওয়াফে জিয়ারতকে তাওয়াফে ইফাদা বা হজের তাওয়াফ বলা হয়। ১০ই জিলহজ পাথর নিক্ষেপের পর হতে তিন দিন পর্যন্ত এই তাওয়াফ আদায় করা যায়।
এছাড়া হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, হজের ওয়াজিব কার্যাবলী পাঁচটি। মুজদালিফায় অবস্থান করা, সাফা-মারওয়াতে সায়ী করা, জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করা, ইহরাম ভঙ্গ করার নিমিত্তে মাথা মু-ানো বা চুল কাটা এবং বিদায়ী তাওয়াফ করা। এছাড়া হজের মধ্যে অসংখ্য সুন্নাত কার্যাবলী রয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে হজ ফরজ হওয়ার পর তা তাৎক্ষণিক না বিলম্বে অবকাশসহ আদায় করা ফরজ? এর উত্তরে হজরত ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ (রহ.) এর মতে, হজ ফরজ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক আদায় করা ফরজ। মহান রাব্বুল আলামীন বিশ্ব মুসলমানদেরকে একত্রিত করার নিমিত্তে হজের যে বিধান তাঁর বান্দাদের প্রতি আবশ্যক করে দিয়েছেন তার ফজিলত ও মর্যাদা অত্যধিক। বরাদ্ধ রয়েছে জান্নাত। হাদীস শরীফের ভাষায়- ‘হজ্জে মাবরূর এর প্রতিদানই হলো জান্নাত’। অন্য এক হাদীসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেছেন, যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে দূরে থাকল, সে ঐ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে, যাকে তার মা এই মূহুর্তে প্রসব করেছে। (বোখারী)
মহান আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা একই সাথে একই কার্যাবলী আদায়ের মাধ্যমে যে নজীর স্থাপন করে তা ইতিহাসের পাতায় বিরল। ইসলাম ধর্ম যে ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, মুসলমানরা যে পরস্পর ভাই ভাই তার উজ্জল ও উৎকৃষ্ট নমুনা হল পবিত্র হজ। অন্য ভাষাভাষীদের সাথেও ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রত্যেকে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। আদান-প্রদান হয় ভালোবাসা, সৌহার্দ্য আর প্রীতির। যে ভাবের বিনিময় গড়ে তোলে ঐক্য, সম্প্রীতি। লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক