গার্মেন্টস
যায়নুদ্দিন সানী: বাজারে নতুন ক্রেজ শুরু হয়েছে। গার্মেন্টস নিয়ে গল্প লেখা। সম্প্রতি জনৈক লেখিকা গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ে একটা গল্প লিখে বিদেশি এক পুরস্কার পেয়েছেন। এরপরে বাঙালি যা করে আর কি। একদল নেমে পড়ল, উনাকে তোষামোদ করতে, ‘দারুণ গল্প’ ‘বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান’ ইত্যাদি। আরেকদল নেমে পড়ল, ‘তেমন উন্নত কোনো গল্প তো মনে হল না’ টাইপ সমালোচনায়। আর কিছু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বসলেন, ‘গল্পটায় যে গার্মেন্টস কর্মীর চিত্র আঁকা হয়েছে, বাস্তবতার সাথে তার মিল নেই।’ ব্লা ব্লা ব্লা। এতসবের ভিতরে আরেকটা ঘটনা ঘটল। আমার নিজের একটা গল্প লেখার শখ হল। গার্মেন্টস নিয়ে। গল্পটা কিন্তু সত্যি। মানে বাস্তবতার সাথে হুবহু মিল আছে। পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা যদিও জিরো, তবে বাজারের যে গতি প্রকৃতি, আলোচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আসলে সেজন্যেই লেখা। তো শুরু করি?
প্রথমে আমার পরিচয়টা সেরে ফেলি। আমি ডাক্তার। মানে পেশায় ডাক্তার। ডাক্তার পরিচয় অবশ্য আজকাল অনেকেই দেয়। পল্লী চিকিৎসক থেকে শুরু করে ফার্মেসির মালিক। হয় নিজেই ডাক্তার পরিচয় দেয় আর নয়তো তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা সম্মান দেখিয়ে ডাক্তার বলে ডাকে। ফলাফল হচ্ছে, ডাক্তার পরিচয় দেয়ার পরে আমাদের আবার বিস্তারিত জানাতে হয়, ‘আমি অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার’ আর নয়তো বলতে হয় ‘এমবিবিএস ডাক্তার’। আমার সম্পর্কে অবশ্য আরেকটু কথা বলার আছে। আর সেটা হচ্ছে, আপনাদের দোয়ায়, এমবিবিএস পাস করার পরে একটা উচ্চতর ডিগ্রিও করেছি। কিছুটা পড়াশোনা করে আর কিছুটা পরীক্ষকের বদান্যতায় আরও একটি পরীক্ষা পাস দিয়েছি। এর অর্থ হচ্ছে, আমি এখন সাইনবোর্ডে লিখতে পারি, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’। ভিজিট তিন ডিজিটে। বছর বছর বাড়াবার একটা ফ্রি লাইসেন্সও আছে। সব মিলিয়ে আমার পুরো পরিচয় হচ্ছে, একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, যার মোটামুটি একটা পসার আছে, শহরের হাসপাতালের পাশেই একটা এসি চেম্বার আছে এবং সেখানে আমার ফাইফরমাস খাটবার জন্য একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। ভিজিট কিংবা রোগীর সংখ্যা কোনোটাই বলব না, ইনকাম ট্যাক্স প্রবলেম হতে পারে।
তো, যেদিনের গল্প বলছি, সেদিন যথারীতি বিকালে চেম্বারে বসেছি। দরজার বাইরে অবস্থান করা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট একটার পর একটা রোগী ঢোকাচ্ছে। যথারীতি সেগুলোকে দেখছি। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে ইনভেস্টিগেশান দিচ্ছি। সবই যে নতুন রোগী, এমন না। পুরনোও আছে। চিকিৎসকদের ভিজিটের ক্ষেত্রে সাধারণত অলিখিত যে নিয়ম আছে, তা হচ্ছে প্রথমবারের ভিজিটের চেয়ে দ্বিতীয়বারের ভিজিট কিছু কম হয়। সো, পুরনো রোগী মানে, এদের ক্ষেত্রে আয় কিছুটা কম। একে তো ভিজিট কম তার ওপর আবার গতদিন যেহেতু ইনভেস্টিগেশান করিয়েছে, তাই আজকে আবার ইনভেস্টিগেশান দেয়া যাচ্ছে না। সো, কমিশনও নাই। তবে পুরনো রোগী একটা সুবিধা দেয়, আর তা হচ্ছে ভালো হওয়া রোগী, আবার নতুন একজনকে বেঁধে আনে। এবং সেটায় কোনো দালালি দিতে হয় না, পিওর পরোপকার। মোটা দাগে এই হচ্ছে আমাদের আয়ের উৎস।
একটু অযথা প্যাঁচাল পাড়ছি, তবে কারণ আছে। তো যা বলছিলাম। একটা সময় ছিল, যখন রোগীরা শহরে আসত, বিভিন্ন ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসে তাদের ডিগ্রির নাম পড়ত। কী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তা দেখত, এরপরে নিজেই সিদ্ধান্ত নিত, কাকে দেখাবে। অনেক সময় পরিচিত ‘পরোপকারী’ কেউ হয়তো বলত, অমুক ডাক্তারকে দেখাও, আমারও এই সমস্যা হয়েছিল, এই ডাক্তার দেখিয়ে উপকার পেয়েছি। বাট দ্যাট ডেজ আর গন। বাজার অর্থনীতির জোয়ারে, সবকিছুতেই চলে এসেছে মুনাফা আর কমিশন। এখন আর কেউ পরোপকার করে না, উপদেশও দেয়, কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে।
হবে না-ই বা কেন? মার্কেটে এখন অনেক ডাক্তার, অনেক বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞের ওপর আবার রয়েছে অতি বিশেষজ্ঞ। তার ওপর অতি অতি বিশেষজ্ঞ। এমন সব বিষয়, যার নাম সাধারণ মানুষ শোনেইনি। রোগী হয়তো জানেই না, যে রোগ তার হয়েছে, তার সর্বাধুনিক চিকিৎসা জানা ডাক্তার কোথায় পাওয়া যায়। আর তাই প্রায় কোনো রোগীই জানে না, তার বর্তমান সমস্যার জন্য সে কাকে দেখাবে। সো, আমদানি হয়েছে, ‘বোঝানো বিশেষজ্ঞে’র। ইনাদের কাজ হচ্ছে, উপদেশ দেয়া, ‘আপনার আসলে লিভারের সমস্যা, লিভারের ডাক্তার দেখাতে হবে’।
এমতাবস্থায়, আমাদের মতো অতি বিশেষজ্ঞদের হয়েছে সমস্যা। রোগীরা এমন সব বিশেষজ্ঞের নামও শোনেনি। জানেও না কী কী সমস্যা হলে আমাদের কাছে আসতে হয়। কোনো ডাক্তারই অন্য ডাক্তারের কাছে রোগী পাঠান না। সো, আমাদের কপালে তখনই শিকে ছেঁড়ে, যদি কোনো উপদেশ বিশেষজ্ঞ কোনো রোগীকে বলেন, ‘আপনার সমস্যা আসলে ফুসফুসে। মেডিসিনকে দেখায়ে হবে না, ফুসফুস বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে।’
বলাই বাহুল্য, সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুলে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। সেটা ইদানিং কমবেশি সব ডাক্তারই করছেন। কিছু দালাল বা উপদেশ বিশেষজ্ঞ পুষছেন। এদের কাজ হচ্ছে, গ্রাম থেকে বোঁচকা-বাচকি নিয়ে আসা রোগীদের বিনামূল্যে উপদেশ দেয়া। ‘আরে চাচা, কোথায় যাবেন?’ বলে আলোচনার শুরু আর একজন চিকিৎসকের চেম্বারে প্রবেশ করিয়ে কিঞ্চিৎ বখশিশ পাওয়ার মাধ্যমে আলোচনার সমাপ্তি। চিকিৎসককে ক্ষেত্র বিশেষে তার প্রাপ্ত ভিজিটের কিছু অংশ দিয়ে দিতে হয়।
কাহিনীর আরও একটা শাখা আছে। অনেক সময় কিছু বুদ্ধিমান রোগী গ্রামের কোনো একজন পল্লী চিকিৎসককে অনুরোধ করেন, ‘শহরের কিছু তো চিনি না, আপনি সাথে চলেন।’ সো, আরও এক জাতের উপদেশ বিশেষজ্ঞের বাজারে আগমন। রোগী যদিও মনে করে এই উদার মানুষটি, ততধিক উদারতা দেখিয়ে তার জন্য শহরে এসেছেন, তবে বাস্তবতা ভিন্ন। উনি এসেছেন অন্য কারণে। রোগীটিকে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে বখশিশ নেয়া আর নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করিয়ে কমিশন নেয়াই উনার উদ্দেশ্য। দিন শেষে তিনি এই আপাত উদারতার জন্য একটা মোটা অংকের বখশিশ ও কমিশন নিয়ে বাসায় ফিরবেন। বলাই বাহুল্য, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো দালালের তুলনায় ইনাদের দাবি কিঞ্চিৎ বেশি। মোটা দাগে এই হচ্ছে একজন রোগীকে ঘিরে চিকিৎসক, রোগীর দালাল এবং পল্লী চিকিৎসকের তৈরি হওয়া নেক্সাসের ইনসাইড স্টোরি।
এবার গল্পটা বললে, আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। তো সেদিন চেম্বারে রোগী দেখছি। আমার অ্যাসিস্ট্যান্টের অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটা কাজ হচ্ছে আমাকে ইশারা দেয়া। কোন রোগীটা দালাল নিয়ে এসেছে আর কোনটা আমার কোনো নিজস্ব রোগী পাঠিয়েছে। সেই কাজের অংশ হিসেবেই একটা রোগী বের হওয়ার পরে, জানান দিল, ‘স্যার নতুন রোগীটায় পিসি আছে।’
পিসি মানে হচ্ছে পল্লী চিকিৎসক। আর ‘পিসি আছে’ বলার মানে হচ্ছে, এই রোগীকে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি ইনভেস্টিগেশান দিতে হবে। আর ভিজিটের টাকা থেকে উনাকে কিছু বখশিশ দিতে হবে। অভ্যস্ত কণ্ঠে বললাম, ‘ঠিক আছে।’ রোগী প্রবেশ করল।
রোগিনী একজন তরুণী। সাথে বেশ কিছু ফাইল-পত্তর। খান কয়েক এক্সরে করা আছে। সেসব দেখাতে চাচ্ছিল। যদিও জানি ওসব দেখলে আমি রোগ সম্পর্কে একটা আন্দাজ পেয়ে যাব, তারপরও ওসব দেখলাম না। আসলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস যে ফর্মূলায় চলে, তাতে ওসব দেখা যাবে না। দেখলেই, পিসি নাখোশ, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক নাখোশ আর আমার ভেতরে লোভী মানুষটাও নাখোশ। সো, লেটস কনসেন্ট্রেট অন বিজনেস।
রোগীর নাম, বয়স এসব লিখলাম। সমস্যা জানতে চাইলাম। ঘুসঘুসানি জ্বর আর কাশি। ফুসফুসে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে বুঝে গেলাম ফুসফুসের বাইরের ঝিল্লিতে পানি জমেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় প্লুরাল ইফিউশান। আমি এত সহজে রোগ বুঝে গেলে অনেকের পেটে লাথি পড়বে। সো, অ্যাক্টিং শুরু করতে হবে। রোগীকে বোঝাতে হবে, ইনভেস্টিগেশান করা কতটা জরুরি।
রুগীনির অবস্থাও মনে হল বিশেষ সুবিধার না। আমার কাছে আসবার আগে বেশ কয়েকজন ডাক্তার সম্ভবত উনি দেখিয়েছেন এবং কমবেশি সবাই মনের সুখে ইনভেস্টিগেশান দিয়ে টু পাইস কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন। এবং রোগীকে অনেকটাই সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছেন। এবার আমার পালা। বিবেক কিছুটা ‘কিন্তু কিন্তু’ করছে, বাট উপায় নেই। ‘ঘোড়া ঘাসসে দোস্তি কারেগা তো খায়েগা ক্যা?’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলাম। পিসি সাহেবকে খুশি করতে বেশ কিছু অযথা ইনভেস্টিগেশানও দিতে হল। করুণ মুখে রোগীনি সেটা মেনে নিল। আমিও পরের রোগীতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রিপোর্ট দেখাবার আবার অনেক জাতের নিয়ম আছে। কেউ কেউ রিপোর্ট দেখবার জন্য পুনরায় ভিজিট নেন। কেউ আবার নেন না। যে এলাকায় যে নিয়ম। আমি যেখানে প্র্যাকটিস করি, সেখানে রিপোর্টের জন্য আলাদা ভিজিট নেয়ার নিয়ম নাই। আর রিপোর্ট সব দেখে, তারপর ওঠাটাই নিয়ম।
যাই হোক, ঘণ্টা দুয়েক পরে ইনভেস্টিগেশানের রিপোর্টগুলোসহ রোগীনি আবার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। নতুন রিপোর্টগুলো দেখতে শুরু করব, এমন সময় রোগীনি বেশ কাতর মিনতি করল, ‘আগের রিপোর্টগুলো দেখবেন না স্যার?’ লোভী মানুষ হলে কী হবে, একেবারে পাথর না। স্মিত হাসি দিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা দেখাও।’ রিপোর্টের টোপলা দেখে বুঝলাম প্রথম যে ডাক্তার উনাকে দেখেছিলেন, তিনি আমার গোত্রেরই। মানে লোভী টাইপ। হেন ইনভেস্টিগেশান নাই, যে করান নাই। বেশ ভালো রকমের একটা ছিল দিয়েছেন।
ওহ হো, বলতেই তো ভুলে গেছি, রোগীনিটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। আর প্রথম যিনি উনার পকেট কেটেছেন, তিনি হচ্ছেন সেই গার্মেন্টসের ডাক্তার। বায়ারদের চাপে সম্ভবত উনাকে রাখতে বাধ্য হয়েছে গার্মেন্টস মালিক। যাই হোক, তিনি কমিশন বাবদ বেশ ভালোই ইনকাম করেছেন। তখন করা এক্সরে তে যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ফুসফুসের ঝিল্লিতে পানি জমেছে, তারপরও তিনি চিকিৎসা তেমন দেননি। উনি রেফার করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞের কাছে। সেই বিশেষজ্ঞ যথারীতি আবার ইনভেস্টিগেশান করিয়েছেন এবং চিকিৎসা দিয়েছেন। এসব করতে গিয়ে রোগীনির জমানো টাকা সম্ভবত শেষ হয়ে যায়। অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় গ্রামে ফিরে আসে। এবার পড়েন আরেক দালালের খপ্পরে আর বর্তমানে আমার খপ্পরে। যাই হোক, পুরনো ইনভেস্টিগেশান দেখবার পরে সদ্য করা ইনভেস্টিগেশানগুলো দেখলাম। শেষ এক্সরেটা মাত্র পাঁচদিন আগে করা। নতুন করে ইনভেস্টিগেশান না করালেও চলত। বাট, উপায় নেই।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা শেষ। এবার চিকিৎসা দেয়ার পালা। আমার সিদ্ধান্ত যক্ষ্মা জনিত কারণে পানি জমেছে। বাট চিকিৎসা শাস্ত্র মতে তা বলা যাবে না। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। আর সেটা করতে হলে সেই পানি বের করে পরীক্ষা করতে হবে। আর সেটা করতে আমি আবার আলাদা চার্জ নিই। রোগীকে ব্যাপারটা জানালাম। রোগীর অবস্থা তখন কাঁদো কাঁদো। দুঃখের কথা বলতে লাগল। যার সারাংশ হচ্ছে, তার নিজের জমানো টাকা তো ইতিমধ্যে শেষ করেছেই, এখানে এসেছে ধার করে। তার ওপর বেশ কয়েকদিন কাজে যেতে পারেনি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আনএথিক্যাল চিকিৎসা যে একেবারে দিই না, এমন না। অনেক সময়ই কাজটা করি। যখন বুঝলাম, এই রোগীর কাছ থেকে আর টাকা বের করবার উপায় নাই, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার রোগীরই উপকারের জন্যই একটু আনএথিক্যাল কাজ করি। সন্দেহের উপর ভিত্তি করেই যক্ষ্মার চিকিৎসা লিখে দিলাম। আমার অভিজ্ঞতা বলে, রোগী ঠিক হয়ে যাবে আর সপ্তাহ তিনেকের ভেতরেই কাজে যেতে পারবে। স্টিল, রোগীর কাছ থেকে আরেকবার আয়ের সুযোগটা ছাড়লাম না।
বললাম, ভয়ের কিচ্ছু নেই। একদম সুস্থ হয়ে যাবা। দু’সপ্তাহ পরে আরেকবার দেখিয়ে নিতে। রোগীনি রাজি হল। এবার মিনমিন স্বরে করুণ একটা আর্তি জানাল। ‘স্যার যদি ছুটির জন্য একটু লিখে দিতেন তাহলে উপকার হয়। নাহলে চাকরি চলে যাবে।’
খসখস করে প্রেসক্রিপশানের নিচে লিখে দিলাম, ‘দুই সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রাম’। সারা মুখে হাসি। জানালাম, এটা ফটোকপি করে পাঠাও, এতে না হলে, আমি আলাদা মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে দিব। আমার আশ্বাসে বেশ খুশি মনেই রোগীনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। পরের রোগী দেখতে শুরু করলাম।
আরেকটা কথা বলা হয়নি। রোগীর ভিজিটের টাকা আমি নিজে নিই না। বাইরে আমার যে অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে সে নেয়। দালালদের যা বখশিশ দেয়ার, সে-ই ওখান থেকে দিয়ে দেয়। বাকি যা থাকে সেটা মাঝে মাঝে রোগী দেখার ফাঁকে আমার হাতে দিয়ে যায়। তো কিছুক্ষণ পরে দেখি ভিজিটের টাকার সাথে আলাদা দুশো টাকা দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কিসের?’
: মেডিকেল সার্টিফিকেট দিলেন যে স্যার।
: ওটার জন্য আবার টাকা নিতে গেলি ক্যান?
: আমি নিইনি স্যার, পিসি নিছে। পাঁচশ। আপনার কথা বলে। আমি দেখতে পেয়ে আমাদের ভাগ নিয়ে নিছি।
ছেলেটার নজর বেশ তীক্ষè। মাঝে-মাঝেই রোগীরা চালাকি করে। টাকা নাই, গরিব মানুষ, এসব বলে ভিজিট কম দেয়ার চেষ্টা করে। বাট ওর চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। লুকোনো পকেটে রাখা টাকাও দেখে ফেলে। ফলে, ওকে ফাঁকি দিতে পারে না। বেশ বুদ্ধিমান। আর আমার বুদ্ধি বলে, একে খুশি রাখা জরুরি। সো, দুশো টাকার ভেতর থেকে একশ টাকা ওকে দিলাম।
: এটা রাখ।
বাকি টাকাটা পকেটে ঢুকালাম।
জীবনটা খুব সুন্দর। কী বলেন?
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট