২৪ বছর পর কেমন বাংলাদেশ চাই
অধ্যাপক ড. এম এ মাননান
ইদানিং আমরা বাংলাদেশিরা অনেক অনেক স্বপ্ন দেখছি। কিছু স্বপ্নের বাস্তবায়নও দেখছি। আমাদের প্রত্যাশা, সব স্বপ্নের বাস্তবায়ন হোক ক্রমান্বয়ে। তবে ২৪ বছর পরে বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশের মর্যাদা পাবে, তখন কেমন বাংলাদেশ পাব তার স্বপ্নও আমরা দেখতে শুরু করেছি। কেমন বাংলাদেশ? এমন বাংলাদেশ দেখব, যেখানে দুর্নীতি শূন্যস্তরে নেমে যাওয়ার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন অফিস গুটিয়ে চলে গিয়েছে। ‘আসুন, সবাই দুর্নীতিকে না করি’ এমন সেøাগান নিয়ে কেউ রাস্তায় নামছে না। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশে জনগণ হয়রানিমুক্ত জীবনযাপন করছে, অফিস-আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাসিমুখে সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকছে। জনগণ হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরছে আর সেবাদানকারীদেরকে বেহেশতের সুন্দতরতম স্থানে অধিষ্ঠিত করার জন্য স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করছে। বাংলাদেশ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে একজনও হতদরিদ্র নেই; দারিদ্র্যসীমার নিচে কতজন লোক আছে তা অর্থনীতিবিদগণ হিসাব করতে গিয়ে হতবাক হয়ে দেখছেন, তাদের ক্যালকুলেটরে যে সংখ্যা আসছে তা ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। তারা আরও চমকে যাচ্ছেন যখন দেখছেন যে, সম্পদের এমন সুষম বণ্টন হয়েছে, যার ফলে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ২২ কিংবা ২২০০০ পরিবারের মধ্যে কোনো সম্পদই কেন্দ্রীভূত হতে পারেনি; গ্রাম আর শহরের জনগণের জীবনযাত্রার মানে কোনো পার্থক্যই নেই, গ্রাম ছেড়ে আর মানুষ শহরমুখী হচ্ছে না। জেলায় আর উপজেলায় এত বেশি উন্নতমানের স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে যে, গ্রামের শিক্ষার্থীদের আর শহরে গিয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য অমানবিক পরিশ্রম আর প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। অভিভাবকদেরও যেন শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কিছু করার নেই।
জঙ্গিবাদী বা কোনো বোমা সাপ্লাইয়ারকে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া দুস্কর। হলি আর্টিজানের মতো নির্মম ঘটনা কল্পনার বাইরে। সিসি ক্যামেরার বাজারে ধস নেমেছে, এসব ক্যামেরা উৎপাদক-কোম্পানিগুলো কারখানা বন্ধ করে অন্য ব্যবসায়ে চলে গিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বের সকল দেশ বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে শুধু বেছেই নেয়নি, আমাদের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে সেখানে সন্ত্রাসীদের হৃদয়ে ভয়ঙ্কর ভীাতির স্রোত তৈরি করে দিচ্ছে।
আকাল নেই, মহামারি নেই, চিকুনগুনিয়া চিরতরে তার নিজ জন্মস্থান তানজানিয়ায় চলে যাওয়ায় কোনো মেয়রকে ব্যর্থতার দায় নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার দরকার হচ্ছে না। বাংলাদেশের সব শহরের ড্রেনে-নালা-নর্দমায় রুই-কাতলা ছেড়ে দিয়ে মশার লাভা নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বন্যা নামক জিনিসটি যেন মানুষ ভুলেই গিয়েছে। সব নদীকে এমন প্রযুক্তি দিয়ে শাসন করা হচ্ছে যে, কূল ভাঙার তাদের কোনো সাহসই নেই। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চিরস্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাস্তায় যানজট? অসম্ভব। এ সম্পর্কে কিছু জানতে হলে যাদুঘরে যেতে হবে। রাজধানী ঢাকায় যানজট কিংবা জলজট কল্পনাই করা যায় না। আর নগরায়নের বিষয়টা? কুয়ালালামপুর, দুবাই বা সাংহাই, এর ধারে-কাছেই আসতে পারবে না। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো, আহা কী সুন্দর! সব ফোর লেন। ঝক্ঝকে তক্তকে। রেল লাইনগুলো সব জাপানের মতো। রেলের বগির দিকে নজর দিলে হৃদয়টা জুড়িয়ে যায়। গতির কথা আর কী বলব! শত্রুরাও সমালোচনা করতে পারবে না। বিরোধী দলগুলোর মুখ একেবারেই বন্ধ। রাস্তায় সামান্যতম ভাঙা না থাকায়, রেলে সিডিউল বিপর্যয় না ঘটায় তারা সরকারকে তুলোধুনো করার কোনো মওকাই পাচ্ছে না।
বিশ্ববাসী বিস্ময় ভরে দেখছে, বাংলাদেশে বিগত সময়ের মতো এখন সরকার বদল হলে নতুন সরকার বিগত সরকারের সমালোচনা করে না। তাদের অসমাপ্ত কাজগুলোকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয় না। পরিকল্পনাগুলোকে অসার ঘোষণা করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় না। কোনো দক্ষ কর্মকর্তাকে দলীয় বিবেচনায় বছরের পর বছর ওএসডি করে ফেলে রেখে মানবসম্পদের অপচয় করে না। সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ ভুলেও নিজকে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে একাকার করে আমলাতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। সংবিধানের অসম্মান করে না। সংসদের অধিবেশনে প্রতিপক্ষকে অসম্মান করার লক্ষ্যে কেউ অশোভন ভাষা ব্যবহার করে না। কেউ ধর্মীয় ধোয়া তুলে হাজার বছরের লালিত বাঙালি ঐতিহ্যকে মুছে ফেলতে চায় না।
দেখা যাচ্ছে, সবই পাল্টে গিয়েছে। ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দেওয়াকে শুধু অসম্মানজনকই মনে করছে না, গুরুতর পাপ হিসেবে দেখছে। আগের ঘুষখোররা এখন সন্তানের কাছে প্রশ্ন শুনতে চায় নাÑ ‘বাবা, তুমি কী ঘুষ খাও? তুমি কত টাকা বেতন পাও? এত এত দামি জিনিস তুমি কীভাবে কিনেছ? মাকে এত দামি দামি গয়না কিনে দিয়েছ, কোথা থেকে তুমি টাকা পাও?’ ঘুষখোররা বদলে গিয়েছে। তারা বরং যারা ঘুষ দিতে চায়, তাদেরকে কঠিন ভাষা শুনিয়ে দেয়। মাছ বিক্রেতারা মাছে আর ফল বিক্রেতারা ফলে ফরমালিন/কার্বাইড দেওয়ার কথা যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে। পুরনো কথা একেবারেই মনে করতে চায় না। যৌতুক, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, পুরুষ নির্যাতন, ইভটিজিং, বখাটেপনা, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, রংবাজি, মাস্তানি, শ্লীলতাহানি, পরনিন্দা, দলনিন্দা, ঠকবাজি কী জিনিস তা বাংলার মানুষের জানা নেই। ধন্য বাংলাদেশ, ধন্য নতুন বাংলাদেশের রূপকারগণ। (চলবে-০১)
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষক ও ব্যবস্থাপনাবিদ