তিন রতœ
া মোস্তফা কামাল গাজী
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি ছাড়া কেউ দোলনায় থেকে কথা বলেনি। তারা সবাই ছিলো বনি ইসরাইলের।
১.ইসা ইবনে মারইয়াম (আ.)।
মারইয়াম (আ.) এর গর্ভে ইসা (আ.) অলৌকিকভাবে জন্মগ্রহণ করলে লোকজন তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো। তখন মারইয়াম (আ.) এর ইঙ্গিতে ইসা (আ.) তাঁর মায়ের পক্ষ থেকে জবাব দিয়ে বললেন, “আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজিল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।
আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি। আমার প্রতি শান্তি প্রেরিত হয়েছে যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুত্থিত হব।” (সুরা মারিয়ামঃ ২৯-৩৩)
২. ছাহেবে জুরাইজ (জুরাইজ সংশ্লিষ্ট একটি বাচ্চ)।
জুরাইজ একজন আল্লাহর অনুগত বান্দা ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি ইবাদতগাহ তৈরি করলেন। তিনি সেখানে থাকাবস্থায় একদিন তার মা সেখানে এলেন। এ সময় তিনি নামাজ পড়ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেন, “ হে জুরাইজ!” তখন তিনি (মনে মনে) বলেন, “ হে প্রভু! একদিকে আমি নামাজ পড়ছি আর অন্যদিকে আমার মা ডাকছে। কোনটা করবো এখন!”
জুরাইজ নামাজ ভাঙলেন না। তার মা চলে গেলেন। পরদিন তার মা আবার এলেন। তখনও তিনি নামাজে মগ্ন ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেন, “হে জুরাইজ!” তিনি (মনে মনে) বললেন, “হে প্রভু ! একদিকে আমি নামাজ পড়ছি আর অন্যদিকে আমার মা ডাকছে। কোনটা করবো আমি!
তিনি নামাজেই রত থাকলেন। এভাবে তৃতীয় দিনেও জুরাইজ নামাজ পড়ার সময় তার মায়ের ডাকে সাড়া না দেয়াতে তার মা বদদোয়া করতে লাগলো, “ হে আল্লাহ! একে তুমি জেনাকারিনী নারীর মুখ না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না।
বনি ইসরাইলের মধ্যে জুরাইজের ইবাদতের কথা খুব প্রসিদ্ধ ছিলো। সে সময় জুরাইজের শহরে এক ব্যভিচারী নারী ছিলো। সে ছিলো উল্লেযোগ্য রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিণী। মহিলাটি জুরাইজকে অপকর্ম করতে ফুসলাতে লাগল। কিন্তু জুরাইজ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এতে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো মহিলাটি। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে লাগলো সে। জুরাইজের ইবাদতগাহের কাছাকাছি এক রাখাল পশু চড়াতো। মহিলাটি রাখালের সঙ্গে অপকর্মে লিপ্ত হলো। এতে মহিলাটির গর্ভে রাখালের সন্তান এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলে মহিলাটি বলতে লাগলো, “এটা জুরাইজের সন্তান।” বনি ইসরাইল (ক্ষিপ্ত হয়ে) জুরাইজের কাছে এসে তাকে ইবাদতগাহ থেকে বের করে আনলো, তার ইবাদতগাহ ভেঙ্গে দিলো এবং তাকে মারধরও করতে লাগলো। জুরাইজ বললেন, “তোমাদের কি হয়েছে? আমাকে মারছো কেনো?” তারা বলল, “তুমি এই নষ্টা মহিলার সঙ্গে জেনা করেছ। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে।” তিনি বললেন, “শিশুটি কোথায়?” তারা শিশুটিকে নিয়ে এলো। জুরাইজ বললেন, “আমাকে একটু সুযোগ দাও নামাজ আদায় করে নেই।” তিনি নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষ করে তিনি শিশুটির কাছে এসে তার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, “এই শিশু! বলো তোমার পিতা কে?” শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, “আমার পিতা অমুক রাখাল।
কওমের লোকেরা তখন জুরাইজের কাছে এসে তাকে চুম্বন করতে লাগলো এবং তার শরীরে হাত বুলিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো। লোকেরা বলল, “এখন আমরা তোমার ইবাদতগাহটি সোনা দিয়ে তেরি করে দেই।” জুরাইজ বললেন, “দরকার নেই, বরং আগের মতোই মাটি দিয়েই তৈরি করে দাও।” কওমের লোকেরা তাই করলো।
৩. বনি ইসরাইলের একটি শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিলো। এমন সময় একটি লোক দ্রুতগামী ও উন্নত জাতের একটি পশুতে সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। তার পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই দামী। শিশুটির মা বললো, “ হে আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে এই ব্যক্তির মত যোগ্য করো।
শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে এসে তাকে দেখতে লাগলো। এরপর বলতে লাগলো, “ হে আল্লাহ! আমাকে এই ব্যক্তির মতো করো না।” অতঃপর ফিরে এসে পুনরায় মায়ের দুধ পান করতে লাগলো। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি যেনো এখনও দেখছি রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুটির দুধ পানের চিত্র তুলে ধরছেন এবং নিজের তর্জনী মুখে দিয়ে চুষছেন।
(বর্ণনাকারী পুনরায় হাদিস বর্ণনা করতে লাগলেন) ঠিক সে সময় লোকেরা একটি বাদিকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছিলো আর বলছিলো, “তুমি জেনা করেছো, চুরি করেছো।” মেয়েটি বলছিলো, “আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমার উত্তম অভিভাবক”।
শিশুটির মা বললো, “হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে এ নষ্টা নারীর মত করো না।” শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো এবং বললো, “ হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এই নারীর মত করো।” তখন মা ও শিশুটির মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেলো। মা বললো, “হায় দুর্ভাগা! একটি সুশ্রী লোক চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ যোগ্য করে দাও আর তুমি প্রত্যুত্তরে বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এর মত করো না।
আর এই ক্রীতদাসীকে লোকেরা মারধর করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে এবং বলছে, তুমি জেনা করেছো, চুরি করেছো। আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ করোনা। তুমি বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এরূপ করো।” শিশুটি এবার জবাব দিল, “প্রথম ব্যক্তি ছিল স্বৈরাচারী এবং জালেম। সেজন্যই আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এ ব্যক্তির মতো করো না। আর এই মহিলাটিকে তারা বললো, তুমি জেনা করেছো। প্রকৃতপক্ষে সে তা করেনি। তারা বলছিলো, তুমি চুরি করেছো। আসলে সে চুরি করেনি। এজন্যই আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়েটির মতো নিষ্কলুষ করো।” (বুখারিঃ ৩৪৩৬)’
ইউপি, ভারত।