ইসলামে পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনায়ণ
া গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
বৃক্ষ না থাকলে এ দুনিয়াতে আদম সন্তানের অস্তিত্ব অচল হয়ে পড়তো। আদিকালে মানুষ বনের ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করত এবং দুনিয়ার মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে চিরকালই বৃক্ষের উপর নির্ভর করতেই হবে। মানুষের জন্য এই অতি প্রয়োজনীয় নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন; “আমি আকাশের বৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন তৃণলতা সৃষ্টি করেছি, সবুজ গাছ-গাছালি সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা আনআম, ১৮ আয়াত)।
প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। পৃথিবীর মূল সম্পদ হল ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র। আর পরিবেশ-বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৃক্ষ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের জন্য সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে প্রাকৃতিক-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দিক নির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান। তখন তারা আনন্দিত হয়’। (সুরা: রূম, আয়াত: ৪৮)।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, “আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশ স্বরূপ” (আল-কুরআন-৭-৯) জ¦ালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনে আমাদের বেশি করে বনায়ন করার নির্দেশ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন। ইরশাদ হচ্ছে- “যিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ হতে (শক্তি) আগুন উৎপাদন করে দিয়েছেন, সে মতে তোমরা তা হতে (নিজেদের) আগুন জ¦ালিয়ে নিতে পার”। (সুরা রাসান, আয়াত-৮০) পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে- তোমরা যে অগ্নি প্রজ¦লিত কর তা লক্ষ করে দেখছো কি? তোমরাই কি অগ্নি উৎপাদন বৃক্ষ সৃষ্টি কর, না আমি? আমি একে করেছি নিদর্শন এবং মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র। (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত,৭১/৭৩)। পবিত্র কোরআনে মানুষের জন্য আল্লাহ পাকের অসংখ্য নিয়ামত প্রসংঙ্গে স্পষ্টভাবে ইরশাদ হচ্ছে, “মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে প্রকৃষ্টরূপে (ভালভাবে) বিদারিত করি এবং আমি উৎপন্ন করি শস্য, আংগুর, শাক-সবজি, যায়তুন, খেজুর, বহুবৃক্ষ, বিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদির খাদ্য, এটা তোমাদের এবং তোমাদের পশুগুলোর ভোগের জন্য। (সুরা আবাসা, আয়াত: ২৪-৩২)।
কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বৈচিত্রময় প্রকৃতির কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে এর বিচিত্র প্রকার বর্ণ, গন্ধ, ও সৌন্দর্য দেখে মানুষ পুলকিত ও অভিভূত হয়। যেন সব কিছুর উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে মানুষ আল্লাহর কুদরতের কথা স্মরণ করে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে জন্মান শস্য, জাইতুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন’। সুরা: নাহল, আয়াত: ১১
বনের গাছপালা থেকে শুধু কাঠ রাবার, ওষুধ বা ফল-মূলই সংগ্রহ করা হয় না, এগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি দ্রব্য এবং তেলও পাওয়া যায়। বৃক্ষের পরিশুদ্ধ তেল দ্বারা প্রজ্জ্বলিত প্রদ্বীপের সাথে আল্লাহ পাক তাঁর নুরের উপমা দিয়েছেন। মানুষ চেষ্টা-গবেষণা করলে বৃক্ষ থেকেও উৎকৃষ্ট ধরণের তেল আহরণ করতে পারে। এই উপমা নি:সন্দেহে সেই তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। পবিত্র কুরআন ইরশাদ হচ্ছে “এবং সৃষ্টি করি এক বৃক্ষ যা জন্মায় সিনাই পর্বতে, এতে উৎপন্ন হয় ভোজনকারীদের জন্য তেল ও ব্যঞ্জন”। (সুরা মুমিনুল, আয়াত: ২০১)
হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃক্ষ রোপণকে সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুল (দ:) বলেছেন, মানুষ, পাখী বা পশু তাদের আহার্য গ্রহণ করে তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সদকা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয় (বুখারী-মুসলিম শরীফ) বন ও বণ্য পশু-পাখী আল্লাহ পাকের দান ও প্রকৃতির শোভাবর্ধক। তাই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এগুলোর সংরক্ষণের উপরও বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশের সবুজে বনভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা এবং লোভের কারণে। বন ধ্বংস করে যে আমরা আমাদের সুন্দর-সুস্থ্য ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি তা বোধ হয় আমরা উপলব্ধি করছি না। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ সুন্দর জীবন- যাপনের জন্য অবশ্যই বনায়ন করতে হবে। দেশের কোথাও যাতে অনাবাদী কৃষি জমি পড়ে না থাকে সেজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামগণ যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। যার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অনাবাদী জমি আবাদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে জমির মালিক কেউ ছিল না সে জমিকে যে আবাদ করবে সেই হবে তার সবচেয়ে বেশি হকদার (বুখারী) এভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনগণকে বনায়নে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন।