সনাতন ধর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
া পার্থ প্রতিম মজুমদার
আমাদের ধর্মের নাম ‘সনাতন ধর্ম’। নামটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি শব্দ পাই, – ‘সনাতন’ ও ‘ধর্ম’। সনাতন হলো তাই যা সর্বদাই সমভাবে সত্য। আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে সত্য উপলব্ধি করি তা আপেক্ষিক। একটি মাছি তার পুঞ্জাক্ষি দিয়ে জগৎকে যেরূপে দেখবে, মানুষের উন্নত চোখ সেরূপে দেখবে না। অথচ উভয়েই একই জগৎকে দেখছে। এই দেখা নিরপেক্ষ সত্য নয়, এটা আপেক্ষিক সত্য। যে দেখছে শুধু তার সাপেক্ষেই সত্য। এভাবে আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয় মন ও বুদ্ধি দ্বারা সীমায়িত আপেক্ষিক জগতে বাস করি ও আমাদের অনুভূত আপেক্ষিক সত্যকেই প্রকৃত সত্য বলে মনে করি।
আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিরা বুঝেছিলেন, যতদিন মানুষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আবদ্ধ ততদিন সত্যলাভ অসম্ভব। তারা ইন্দ্রিয়ের বহির্দেশে যাবার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। এভাবেই জন্ম হয়েছে বেদান্ত বা উপনিষদের।
মুনি ঋষিদের অতিচেতন স্তরের উপলব্ধির প্রকাশই উপনিষদ। ইন্দ্রিয়াতীত এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষ হওয়ায় তা ‘সনাতন’। এবার আসি ‘ধর্ম’ কথাটির প্রসঙ্গে। আক্ষরিক অর্থ যাই হোক না কেন, আধ্যাত্মিক পরিভাষায় ‘ধর্ম’ হলো একটি বিকাশের প্রক্রিয়া। পাশবিক মানুষের আনন্দ শুধু শরীরগত। শরীরের সুখ বা ইন্দ্রিয়চরিতার্থতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আর একটু উন্নত হলে মানুষ মানসিক আনন্দলাভের অধিকারী হয়, তখন সে সাহিত্য রস, শিল্পের রস অনুভব করতে পারে। এটাকে মানবীয় স্তর বলা যায়।
আরও উন্নত অবস্থায় মানুষ ঈশ্বরীয় আনন্দে বিভোর হয়, ধ্যানাবস্থায় শান্তির অপূর্ব পরিবেশ অনুভব করতে পারে ; যাকে বলা যায় দৈবী স্তর। এভাবে উন্নত হতে হতে মানুষ যখন দেহ, মন ইন্দ্রিয়ের গ-ি অতিক্রম করে তখনই সে লাভ করে শাশ্বত জ্ঞান বা সনাতন সত্য। সে অনুভব করে সে ক্ষুদ্র নয় সে দেহ নয়, মন নয় এমনকি চিন্তা চেতনাও নয়, সে আত্মা। সে এক অনন্ত, অখ- অস্তিত্ব। মানুষ তখন তার ক্ষুদ্রতার খোলস পরিত্যাগ করে অনন্ত ‘আমিত্বে’ লীন হয়ে যায়।
‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’ Ñ সিংহ যেমন পিঞ্জর ভেঙ্গে ফেলে বেরিয়ে যায় ঠিক তেমনি সে এই জগৎ-জাল ভেদ করে মুক্ত হয়ে যায়। ধর্ম হলো এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া, যা পশুকে মানুষে, মানুষকে দেবতায় এবং দেবতাকে ঈশ্বরে বিকশিত করে। ঋষিদের আবিষ্কৃত এই সত্যলাভের পথই সনাতন ধর্ম।’