খ্রিস্টান সমাজের নেতারা যুবকদেরকে কতটুকু অনুপ্রেরণা দেন?
চারিদিকে শুধু কথা কাটাকাটি, মামলা, একে অন্যের উপর দোষারোপ এভাবেই চলছে আমাদের খ্রিস্টান সমাজ ব্যবস্থা। গ্রাম থেকে শহরে কোথাও কোন শান্তি নেই। নানা পক্ষে বিভক্ত হয়ে সমাজকে নানা দিকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। নেতারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় যা করার দরকার তাই করছে। অনেকের অনেক টাকা আছে আবার অনেক নেতা কই মাছের তেল দিয়ে কই মাছ ভেজে খাচ্ছে। তারা ভাবে আমরা যারা যুবকরা রয়েছি আমরা কিছুই বুঝি না।
আমরা নেতারা হয়তো ভুলে গেছি জেনারেশন থেকে জেনারেশনে মানুষের বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটে কমে না। তাই আজকে আপনারা যারা নিজেদের বেশি বুদ্ধিমান ভেবে কই মাছের তেলে কই মাছ ভেজে খাওয়ার পরে ভাবছেন কেউ কিছু বুঝতে পারছে না তাহলে আপনাদের চাইতে মূর্খ এই দুনিয়াতে কেউ নেই। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর একটি চিঠির কিছু লাইন উদ্ধৃত করছি যখন তিনি বাবার অমতে বিয়ে করে তার বাবাকে চিঠিটি লিখেছিলেন।
‘আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিক ছাড়া আমি বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনোই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ নয়, স্পষ্টতাই দুটো বিশ্বাসের দ্বন্দ। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি, আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন। চরম সত্য যে, একটি জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার বাবার অমিল ছিলো, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত করতে পারি, পারি কিছুটা মসৃণ করতে। সংঘাত রোধ করতে পারিনা। পারলে ভালো হতে কিনা জানিনা। তবে মানুষের জীবনের বিকাল থেকে যেতো পৃথিবীতে’।
কাজেই নেতাদের এটা বুঝলে হবে না যে, আমরা যুবকদের যেদিকে নিব তারা সেদিকেই যাবে। যুবরা নিঃসন্দেহে বর্তমানের নেতাদের চাইতে কম বুঝেনা। কিন্তু এক জায়গায় পার্থক্য গড়ে দেয় সেটা দেশীয় সংস্কৃতি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সমাজের প্রেক্ষাপটে বয়স্কদের কথাকেই সর্বজন গ্রাহ্য বলে মেনে নেয়া হয় আর সেখানে যুবকরা বেশি কিছু বলে না বা মুখ খুলে না। আমাদের যে জেনারেশন গ্যাপ সেটা আমাদের নেতাদের মেনেই যুবদের সাথে চলতে হবে।
আমরা এই ২০ থেকে ৩০ বছরের যুবক সমাজকে যদি আজকে কারো বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেই তাহলে বাকী জীবনগুলো এভাবেই দ্বন্দের মধ্যে কেটে যাবে। নেতারা, আপনারা আর বাঁচবেন কত বছর? বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু হিসেবে কেউ ২০ বছর, কেউ ১০ বছর আবার কেউ একটু বেশি বা কম। তাহলে যে যুবকরা আরো ৪০ থেকে ৬০ বছর বেঁচে থাকবে তাদেরকে কেন অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন? এতে করে যে আমাদের সমাজের মধ্যে স্পষ্টতই বিভেদ করে দেয়া হচ্ছে। আর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব খুবই খারাপ হবে।
আমরা পারি এই ক্ষমতার দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একত্রে কাজ করতে। নেতাদের উদ্দেশ্য কি? অবশ্যই জনগণের জন্য কাজ করা। আর যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে কেন আমরা ক্ষমতা নিয়ে এতো মারামারি করবো, কেন আমরা নিজেদের ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য অন্যের মানহানি করবো? কেন আমরা এই যুব সমাজকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবো?
এই বিভেদ বছরের পর বছর চলতে থাকবে। আর এর ফলাফল আপনাদের-আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটা নেতিবাচক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। আপনারা যারা নেতা আছেন আপনাদের হয়তো টাকা আছে, সেটা যে পথেই উপার্জন করা হউক, সেই কথা আর বলছি না। এই টাকা পয়সা দিয়ে আপনাদের ছেলে-মেয়েদের বিদেশে রেখে হয়তো উচ্চ শিক্ষিত করছেন কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন আপনার সন্তানদের প্রতি আপনি অনিয়ম বা অন্যায় করছেন। আজকে আপনার ছেলে-মেয়ে বাবা-মা’কে কাছে পাচ্ছে না, তারা আপনাদের স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত, একাকী পড়ে আছে অন্যদেশে। এতে করে তাদের মধ্যেও যে আপনাদের প্রতি একটা ভালবাসা জন্মানোর কথা সেটা নিশ্চই আপনারা আশা করতে পারেন না।
আজকে আপনারা যে টাকা দিয়ে নিজেদের কাজে যুবকদেরকে ব্যবহার করছেন, যুবকদের আপনাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, তারা কি আপনাকে ভালো ভাবে নিচ্ছে? হয়ত সামনাসামনি কিছু বলছে না আর সেটা বলবেও না এর কারণ আমি আগেই বলেছি। কিন্তু এদের মধ্যে এই মনোভাব গড়ে দেয়ার জন্য আপনারাই দায়ী।
আমাদের আড্ডায় মাঝে মধ্যেই আমাদের সমাজের ক্ষমতা লোভীদের নিয়ে কথা ওঠে। যেখানে অনেকেই বলে, খ্রিস্টান যদি সংখ্যায় ৩,৫০,০০০ এর জায়গায় ১,০০০,০০০ হতো তাহলে অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা দৌড়ের উপরে থাকতেন। কারণ, এই ক্ষুদ্র সমাজের নেতামির জন্য যেমন নোংরা কাজ আমরা করছি সেই তুলনায় জাতীয় রাজনীতি যারা করে তারাও পরাজিত হবে। এটা ভালো লক্ষণ যে আমরা এমনটা ভাবছি।
খ্রিস্টানদের সংখ্যা যদি ৩৫০০০০ হয় এবং তারা যদি নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দে না জড়িয়ে জাতীয় রাজনীতির কথা ভাবেন তাহলে তাদের সাথে অন্যান্যরাও যোগ দিবেন নিঃন্দেহে। তাহলে সংখ্যাটা কিন্তু বেড়েই যাবে। কুয়ার ব্যাঙ হয়ে না থেকে একটু চোখ খুলে বাইরের জগৎটাকে দেখতে চেষ্টা করুন, দেখবেন মনমানসিকতা পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, আমাদের সমাজের যে ক্ষুদ্র ক্ষমতা সেটা হতে পারে একটা গ্রাউন্ড কিন্তু এটা নিয়ে মারামারি বা বিভেদ এটা কাম্য নয়।
সমাজের যে অবস্থার তৈরি হয়েছে সেটা সমাধান কিন্তু নেতাদেরই করতে হবে। আপনারা সমস্যা তৈরি করেছেন সমাধানও আপনারাই করবেন। নইলে যখন বুড়ো হয়ে যাবেন তখন কেউ দেখতেও আসবে না বা মনে রাখবে না। মারা যাওয়ার পরে হয়ত শ্রদ্ধাঞ্জলী দিবে প্রতি বছর যেমনটা এখন আপনারা করছেন। কাজেই সময় আছে ক্ষুদ্র চিন্তা ঝেড়ে ফেলে, নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ না করে কিভাবে সমাজের উন্নয়ন করা যায়, কিভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই চিন্তা করুন। (মতামত লেখকের নিজস্ব)
লেখক: স্টেফান উত্তম, গণমাধ্যমকর্মী