২০৩০ সালের আগেই সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার : প্রধানমন্ত্রী
হুমায়ুন কবির খোকন : এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার আগেই বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের নিরাপদ পানি পাওয়া নিশ্চিতের আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘ঢাকা পানি সম্মেলন’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এই আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি। ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় এসেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০৩০ সালের আগেই শতভাগ মানুষকে এর আওতায় আনতে কাজ করছেন তিনি। নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব পরিস্থিতির দিকেও নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই নীতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের তাগিদ থেকে নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব পরিস্থিতির দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে ২৪০ কোটি মানুষ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানির অভাবে পৃথিবীতে বছরে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশই শিশু। প্রতিদিন গড়ে বিশ্বে এক হাজার শিশু বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রাণ হারায়। এসব বিষয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এর আগেও তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি-৬ এ অন্তর্ভুক্ত পানি সংক্রান্ত বৈঠকের তিনটি অংশ একটি এই পানি সম্মেলন। গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে এই বৈঠক চলবে আজ রোববার পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে শুক্র ও শনিবার হোটেলে সোনারগাঁওয়ে চলছে ডেল্টা ওয়ার্কিং সেশন। আর পানি সম্মেলনের অংশে শনি ও রোববার নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে আলোচনা চলছে। আজ রোববার বিকালে ‘ঢাকা পানি ঘোষণা’র মাধ্যমে এই পানি সম্মেলন শেষ হবে।
এই দুদিন জাতিসংঘের পানি সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের প্যানেলে বিভিন্ন দেশের সরকারি মুখপাত্রদের (শেরপা) দশম বৈঠকও হবে। এতে ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন অংশ নেবেন। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি ২০৩০-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বর ‘সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’।
তিন দিনের বৈঠকের মধ্যে ‘ঢাকা পানি সম্মেলন-২০১৭’, ডেল্টা সামিটের ওয়ার্কিং সেশন এবং শেরপা বৈঠকগুলোতে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশনের পথে চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত হবে এবং তা মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ কর্মকৌশলও বের হয়ে আসবে বলে আশাপ্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ বিপর্যয়ের জন্য দায়ি পানি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর শতকরা ৭০ ভাগই সংঘটিত হয় বন্যা এবং অন্যান্য পানি সংক্রান্ত দুর্যোগে।
বিশ্বে শতকরা এক ভাগেরও কম পানিসম্পদ পানের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষের সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং প্রযুক্তিগত ভিন্নতায় পানি ব্যবহারের ধরনের পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা হুমকিতেই রয়ে গেছে। বিশ্বের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ কমবেশি সুপেয় পানি সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্বের প্রায় ১০৭ কোটিরও বেশি মানুষ নদী অববাহিকায় বসবাস করেও পানির চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মানুষ্য সৃষ্ট ৮০ শতাংশেরও বেশি অপরিশোধিত বর্জ্য পানি প্রকৃতিতে ফিরে গিয়ে বড় আকারে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করছে বলেও শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন।
নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে তার সরকার ইতোমধ্যেই বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল। ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় এসেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা পাচ্ছেন। এসডিজির নির্ধারিত সময়সীমা ২০৩০ সালের আগেই আমরা শতভাগ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার আওতায় এসেছে। এর মধ্যে শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশনের আওতায় এসেছে ৬১ শতাংশ মানুষ। উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগের হার গত ৮ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়ে বর্তমানে ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ২০০৩ সালেও এই হার ছিল ৪২ শতাংশ। এ বিষয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সময়-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, এসডিজি-৬ অর্জিত হলে এসডিজির আরও অন্তত ৭টি লক্ষ্য অর্জন সক্ষম হবে। এগুলো হচ্ছে- ক্ষুধামুক্তি (এসডিজি-২), সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ (এসডিজি-৩), সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি (এসডিজি-৭), শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো (এসডিজি-৯), টেকসই নগর ও জনপথ (এসডিজি-১১), জলবায়ু কার্যক্রম (এসডিজি-১৩) এবং জলজ-জীবন (এসডিজি-১৪)। পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য ১০০ বছর-মেয়াদি ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, এই দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী ১০০ বছরে পানির প্রাপ্যতা, তার ব্যবহার এবং প্ররিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও পানির বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে ৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতে সমতল, পাহাড় ও উপকূলীয় এলাকাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী ১২টি দেশের সহযোগিতায় ‘ডেল্টা প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণভাবে প্রতিদিনের পানির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশে মূল সমস্যা হচ্ছে আর্সেনিক ও লবণাক্ততা, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের অপ্রতুলতা, পানির অপচয় এবং শিল্প বর্জ্যসহ নানা কারণে পানি দূষণ। এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে আমরা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কার্যকর করে যাচ্ছি। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ