চিকুনগুনিয়া বিস্তার ও জবাবদিহিতা : লেলিন চৌধুরী
চিকুনগুনিয়া জ্বরের তা-বে রাজধানী শহর ঢাকা বির্পযস্ত। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান(আইইডিসিআর)-এর তিনটি জরিপের উপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়েছে ঢাকায় মোট ১৮ লাখ মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এবং হবে। অর্থাৎ প্রতি দশজনে একজন চিকুনগুনিয়ার শিকার। এখানে ঢাকার জনসংখ্যা এককোটি আশি লাখ হিসাব করা হয়েছে। আইইডিসিআর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারিভাবে অনেকেই বলছে আরো বেশি হবে। চিকুনগুনিয়ার তা-বযাত্রা এখনো সমানতালে অব্যাহত রয়েছে। একটি প্রশ্ন অনেকের মনে উদিত হয়েছে-‘চিকুনগুনিয়ার এই মহামারী কি প্রতিরোধ করা যেত?’ প্রশ্নটি তৈরি হওয়ার পিছনে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে বারংবার নানাভাবে চিকুনগুনিয়া বিপর্যয়ের ব্যাপকতা ও তীব্রতাকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা জ্ঞানপাপেরও প্রমাণ রেখেছে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন চিকুনগুনিয়া মহামারী নয়। তার পারিষদবর্গ বিবিধ টিকা টিপ্পনী ব্যাখ্যাসহ দেশের মানুষকে বোঝালেন এটি মোটেই মহামারী রোগ নয়। কেননা এই রোগে মানুষ মারা যায় না। তারা আরো জানালেন এই রোগে কিছুটা ব্যথাবেদনা ছাড়া তেমন কোনো ভোগান্তি হয় না। এর কোনো চিকিৎসাও নেই। শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট খেলেই হয়। ইতোমধ্যে আমরা জেনে ফেলেছি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা মহামারীর সংজ্ঞায় বলেছে- কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়কাল অনুমিত বা আশংকাকৃত সংখ্যার চেয়ে কোনো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে তাকে ঐ রোগের মহামারী বলা হয়। এর সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। যারা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তারা অনুভব করেছে ‘ব্যথা কাহাকে বলে এবং তাহা কত প্রকার ও কি কি ’। এই ব্যথা কয়েক দিন থেকে এক বছরের অধিক সময়কাল স্থায়ী হতে পারে। লোকজন প্রশ্ন তোলা শুরু করলো কতসংখ্যক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে একে মহামারী বলা হবে? এরকম অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন চিকিৎসকগণের বিপক্ষে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্য চিকিৎসকবৃন্দ বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ উপস্থিত হলেন। তারা আরো জানালেন এই রোগের উপসর্গগুলোর যথাযথ চিকিৎসা রয়েছে। এই যুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষজন বুঝতে পারলো- ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তাহলে ঘাপলাটা কোথায়?
আমরা কিছুটা পিছনে ফিরে দেখতে পারি। গত বছরের ডিসেম্বরের ২২ তারিখে আইইডিসিআর তাদের নিজস্ব ওয়েটসাইটে জানায় ঢাকার কলাবাগানে ৩০টি চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
সেখানে আশংকা প্রকাশ করা হয় ঢাকায় দ্রুত চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব হতে পারে। সাধারণভাবে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনো বিষয় জনসাধারণের গোচরে আনার আগে উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। এখানে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলো চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা এবং ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে এই প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত করা। চিকুনগুনিয়া মহামারী আকার ধারণ করায় আমরা মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার চূড়ান্তরূপ দেখতে পেলাম। মানুষ যখন চিকুনগুনিয়ার অসহনীয় ব্যথায় কাৎরাচ্ছে তখন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ দোষারোপের নোংরা খেলায় ব্যস্ত। প্রশ্ন হলো সতর্কবার্তা সঠিক সময়ে দেয়ার চার মাস পর রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পূর্বপর্যন্ত কেন মন্ত্রণালয় প্রতিরোধের ন্যূনতম প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর গাফলতির কারণে লাখ লাখ মানুষ নিদারুণ ভোগান্তির শিকার হলো এবং এখনো হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতির মাথায় হাজার হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপলো। আমরা দাবি করছি অতিদ্রুত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। এই কমিটি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবে। দোষীদের অবশ্য আইনের আওতায় আনতে হবে।
এখন প্রচুর সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। বার্ড ফ্লু, নিপা রোগ, এইচআইভি/এইডস, ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার খড়গ মাথার উপর ঝুলছে। পাশের দেশ ভারতে সোয়াইন ফ্লুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব চলছে। এরই মধ্যে ছয় শতাধিক মানুষ সোয়াইন ফ্লুতে মারা গিয়েছে। বাংলাদেশেও যেকোনো সময় রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম অবস্থায় যাদের দায়িত্বহীনতায় চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থ হলে অন্যান্য রোগের মহামারী বা ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে। যে ছিদ্রপথে একটি বিষধর সাপ প্রবেশ করেছে সে পথে দশটি সাপও প্রবেশ করতে পারে।
লেখক ঃ অধিকার কর্মী