পাকিস্তান সেনাবাহিনী আরেকবার নিজ দেশ জয় করল
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
জন্মের মধ্যেই মৃত্যু নিহিত থাকে বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন ২০১৩ সালে। শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি প্রকাশ্যে মিডিয়ার কাছে বললেন, সশস্ত্র বাহিনী অবশ্যই পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের অধীনে কাজ করবে। কথাটি সাংবিধানিকভাবে সঠিক হলেও বাস্তবতায় সেদিনই নওয়াজ শরিফের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। এতদিন শুধু মোক্ষম সময়েরই অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তানের সব কিছুর ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের কর্ণধার সেনাবাহিনী। তারই পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটল গত ২৮ জুলাই শুক্রবার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা দিল নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অযোগ্য। নওয়াজ শরিফ বুঝতে পেরেছেন আপাতত রণে ভঙ্গ দিতে হবে, তা না হলে আরও বড় বিপদ আসতে পারে, যেমনটি এসেছিল ১৯৯৯ সালে। সেবার সৌদি আরবের অশেষ কৃপায় অল্পের জন্য ফাঁসির রশি থেকে বেঁচে যান। তারপর অনেক ঘটনার পথ পরিক্রমায় নওয়াজ আবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন ২০১৩ সালে। এবার হয়তো নওয়াজ ভেবেছিলেন নতুন সংবিধান তাকে রক্ষা করবে। ২০১০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে পার্লামেন্টে পাস হয় সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী। সংশোধিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ছয় অনুযায়ী সংবিধান স্থগিত ও বাতিলের জন্য মৃত্যুদ-ের বিধানসহ কঠোর শাস্তিমূলক বিধান সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু নওয়াজ শরিফ বুঝতে ভুল করেছেন। সরাসরি ক্ষমতা দখল করার প্রয়োজন আর অতটা আবশ্যক নয়। বরং নেপথ্যে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তাতে অনেক সুবিধা। ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০ বছরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ক্ষমতার বলে রাষ্ট্রের সর্বত্র এমনভাবে বিস্তৃত ও শক্তিশালী করেছে যে, কোনো কিছুই এখন আর তাদের জন্য অসাধ্য নয়। আঙ্গুলের ইশারাই এখন যথেষ্ট। বলা হয় সেনাবাহিনীই এখন পাকিস্তানের সবচাইতে বড় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। ২০০৮ সালে বেনজীর ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপর এই মর্মে একটি সরকারি আদেশ জারি করেন যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রেসিডেন্টের দফতরের অধীনস্থ হয়ে কাজ করবে। কিন্তু মাত্র সাতদিনের মাথায় জারদারি নিজের আদেশ নিজেই বাতিল করে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যান এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। ৭০ বছরে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি, হয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সরাসরি উৎখাত হয়েছেন, আর নয়তো তাদের অঙ্গুলী হেলনে বরখাস্ত হয়েছেন। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই মেয়াদে দুটি প্রধান ঘটনার মধ্যে দিয়ে নওয়াজ শরিফের ভাগ্য বিপর্যয়ের সূচনা হয়। প্রথমত, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পরামর্শ উপেক্ষা করে নওয়াজ শরিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে বিরোধটির শুরু হয়। তখন ২০১৪ সালে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ও কিছু ইসলামপন্থি দল ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে এবং সেখান থেকে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবি করে। প্রায় চার মাস ধরে একটা অচলাবস্থা চলতে থাকে। তারপর নওয়াজ শরিফ সেনা সদরে গিয়ে তৎকালীন সেনা প্রধান রাহিল শরিফের সঙ্গে দেখা করলে পরিস্থিতি তখনকার মতো আপাতত ঠা-া হয় এবং উপরোক্ত দলগুলো অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, দুবার সংবিধান স্থগিতের দায়ে সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফকে নওয়াজ শরিফ বিচারের মুখোমুখি করায় সেনাবাহিনী ভীষণ বেজার হয়। তবে ভারত ফ্যাকটরই নওয়াজ শরিফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। নওয়াজ শরিফের অভিমত ছিল, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান উন্নতি করতে পারে। কিন্তু সেনা কর্মকর্তারা এই নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। ফলে নওয়াজ শরিফ সব সময় একটা দোলাচল ও বিভ্রান্তির মধ্যে থেকেছেন। ভারতের সঙ্গে সংলাপ ও অর্থপূর্ণ সংযোগের প্রতিটি পদক্ষেপই ভ-ুল করে দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তারের জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহম্মদ কর্তৃক ২০১৬ সালের শুরুতে গোপন জঙ্গি আক্রমণ এবং ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে লস্কর-–ই-তৈয়বার জঙ্গি কর্তৃক কাশ্মীরের উরি সীমান্তে আক্রমণ এবং তাতে ১৮ জন ভারতীয় সেনা সদস্যের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সংলাপ-আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি হেলনেই নওয়াজ শরিফ অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন, এমন সন্দেহের পিছনে কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য কারণ রয়েছে। এক. নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ আহরণের অভিযোগ তদন্তে গঠিত জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমে (জেআইটি) দুজন সেনা অফিসারের নিয়োগ। দুই. পরিপূর্ণ বিচারের অপেক্ষা না করে তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই আদালত নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। তিন. নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ উত্থাপনের অনেক আগ থেকেই সেনা শাসক পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন ধরে সেই মামলা ঝুলে আছে। চার. আলোচ্য রায় ঘোষণার পর উল্লাস করেছেন ইমরান খানের দল, জামায়াত-ই-ইসলামের মতো ধর্মবাদী গোষ্ঠী এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, যাদেরকে সবাই মনে করে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের রাজনৈতিক শাখা। ভারতের কবল থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করা এবং ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের অলীক স্বপ্ন ছড়িয়ে মূলত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর ছড়ি ঘুরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জাতীয় নিরাপত্তা ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি এবং অপছন্দের সরকারকে তারা বারবার উৎখাত করছে। একাত্তরে তারা বাংলাদেশের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চাইতে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে। সুতরাং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার দিবাস্বপ্ন কোনো দিন পূরণ হবে না। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে এ যাবৎ সংগঠিত সকল যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে, সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে সীমিত আকারের কারগিল যুদ্ধসহ। তবে ভারতের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজ দেশের সরকারকে বারবার হটিয়ে নিজ দেশকে জয় করতে পেরেছে অনেকবার, যার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ জয় তারা পেল গত ২৮ জুলাই নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে হটানোর মধ্যে দিয়ে।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।