নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি
আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের এই সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। বর্তমান যুগে নির্বাচকম-লী বা ভোটারদের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। কারণ আধুনিক গণতন্ত্র হলো প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থা। গণতন্ত্রকে আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে আইনসভায় প্রকৃত সংখ্যাধিক্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বে কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর মাঝে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা হলো এমন একপ্রকার নির্বাচনি ব্যবস্থা যেখানে নারী-পুরুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভোটারের ভোটদান নিশ্চিত করা হয়। এর মাধ্যমে সংখ্যাধিক্য ভোটে বিজয়ী ব্যক্তি উক্ত এলাকার পক্ষ থেকে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মূলকথা হলোÑ দেশের নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীর স্বপক্ষে দেওয়া ভোটগুলোর সমানুপাতে আইনসভার আসনসমূহ বণ্টিত হবে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বসহ প্রায় ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। আমাদের দেশেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি। তাছাড়া বর্তমান সরকার দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থাকে কার্যকর করার বিষয়টি আমরা অনায়াসে বিবেচনায় নিয়ে আসতে পারি। কারণ গণতন্ত্র বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বুঝালেও সেখানে সংখ্যালঘুদের নির্মূল করা হয় না। সেখানে সংখ্যালঘুদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়ে শাসনব্যবস্থায় তাদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাহলে গণতন্ত্র আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে সক্ষম হবে।
আমাদের দেশে নির্বাচনের সংস্কৃতি সন্দেহপ্রবণতায় পরিপুষ্ট। ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানি শাসন আমল, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ এমনকি পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও নির্বাচনি ফলাফল সবসময় গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। প্রায় সব নির্বাচনে বিজিত দল নির্বাচনে সুক্ষ্ম, স্থূল বিভিন্ন কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনি ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতাকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় তারা সংসদ বর্জন করে রাজপথকে উত্তপ্ত করে চলছে। ফলস্বরূপ অকার্যকর হচ্ছে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি হচ্ছে নির্বাচনের পর বিরোধী দলে অবস্থান করে শুধুমাত্র নিজেদের দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নব্বই দিন অন্তর সংসদে গিয়ে হাজিরা দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও বিরোধী দলকে সংসদে উপস্থিতির বিষয়ে কোনো কার্যকর বা উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে না। ফলে বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলের আহ্বানে কোনো সাড়া দিয়ে থাকে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই কলুষিত চর্চা থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরও অধিক গ্রহণযোগ্য ও গণমুখী করতে হবে। সেজন্য আমরা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার অন্যতম পদ্ধতি ব্যবস্থার চধৎঃু খরংঃ ঝুংঃবস বা দল তালিকা ব্যবস্থাকে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কার্যকর করতে পারি। ফলে কোনো দল কম সংখ্যক ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদে বেশি সংখ্যক আসন লাভ করতে পারবে না। তাছাড়া এর মাধ্যমে শুধুমাত্র বড় দুটি রাজনৈতিক দলই নয় অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলসমূহ কিছু সংখ্যক ভোট লাভ করে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব লাভ করার সুযোগ পাবে। এর মধ্যদিয়ে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকার তত্ত্বগতভাবে নয় প্রায়োগিকভাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
কানাডার নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে জাতীয় এবং প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে ঈযরবভ ঊষবপঃড়ৎধষ ঙভভরপবৎ (ঈঊঙ) বা প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তার হাতে। দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কার্যক্রম পরিচালনা করাই প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তার দায়িত্ব। আর প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তার প্রথম কাজ হলো প্রতিটি নির্বাচনি এলাকার জন্য একজন করে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতে প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তার দফতর থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে প্রার্থীর তালিকা এবং স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী থাকলে তার তালিকাও নির্বাচনি কর্মকর্তার দফতরে জমা দিতে হবে। নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করে দিবে নির্বাচনি কর্মকর্তার দফতর। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে এই নির্বাচনি ব্যয়সীমা মেনে চলতে হবে। নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে নির্বাচনি ব্যয় গণনা শুরু হবে। নির্বাচনের পূর্বে প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তার দফতরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলোÑ একটি নির্ভুল ও পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা তৈরি করা। কানাডায় অবশ্য একটি স্থায়ী ভোটার তালিকা রয়েছে। প্রত্যেক নির্বাচনের পূর্বে এই স্থায়ী ভোটার তালিকা পুনর্বিন্যাস করা হয়।
আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহের সচেতনতা বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফল নিরপেক্ষভাবে গণনা ও প্রকাশ করা হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্টদের সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি আইন প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ, যা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলসমূহের অর্থের উৎস কমিশনের কাছে তুলে ধরার বিধান করা হয়েছে। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে আগামী দিনের সকল নির্বাচন ব্যবস্থায় সচ্ছতা আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু আছে। দেশ দুটিতে এই ব্যবস্থার যথাযথ সুফল লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকর করা হলে এদেশ সংকীর্ণ ও সংঘাতমুখী রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে বহুত্ববাদী ধারায় প্রবাহিত হবে এবং এখানে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথটিও অনেক সহজ ও মসৃণ হবে।
লেখক: উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি (পিআরএল), আনসার-ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান