বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন
দেশীয় শিল্প সম্ভাবনাকে উপযুক্ত প্রযতœ প্রদানের মাধ্যমে স্বয়ম্ভর শিল্প ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব। দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার দ্বারা প্রয়োজনীয় ফিনিশড্ প্রোডাক্ট তৈরিতে দেশের শিল্প খাতকে সক্ষম করে তুলতে হবে এবং এর ফলে বিদেশি পণ্যের উপর আমদানি নির্ভরতা তথ্য মহার্ঘ্য বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগে আর বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহারে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশিত অগ্রগতির হিসাব সংক্রান্ত তুলনামূলক সারণিগুলোর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্পর্কের শুমার ও বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ অর্থনীতির অগ্রগতি ও গতিধারা সনাক্তকরণে অসুবিধা হয় না। দেখা যায় আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ জিডিপির অংশ হিসেবে ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানির মিশ্র প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। অস্থিতিশীল ও ভিন্ন মাত্রিক ট্যারিফ স্ট্রাকচার এর প্রভাব পড়েছে বহির্বাণিজ্যে ভিন্ন অনুপাতে। এতে বোঝা যায়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য সাধারণ সূত্র অনুসরণ করতে দ্বিধান্বিত হয়েছে। উৎপাদন না বাড়লেও সরবরাহ বাড়ার প্রবণতায় মূল্যস্থিতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। আবার ইনফরমাল বর্ডার ট্রেডের ফলে দেশজ উৎপাদনের বিপত্তি ঘটতেই পারে। ইনফরমাল ট্রেড বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অদৃশ্য এক অন্ধগলি ও কালো গর্ত হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের আমদানিকৃত সামগ্রী অন্যদেশে পাচার হয়েছে আবার কোনো কোনো বিদেশি পণ্যের অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে আরোপিত ট্যারিফে দেশি সামগ্রী উৎপাদন ব্যবস্থার স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে।
সবার উপর মানুষ সত্য তার উপরে নাই। মানুষই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ববোধের দ্বারা কর্তব্য কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতিসাধিত হয়। সকলের সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে দেশ জাতি রাষ্ট্রের সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ না আগে মানুষ এ বিতর্ক সার্বজনীন। মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতা মাত্র। রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা ও সুযোগকে নাকচ করে দেয়। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি না হলে চাহিদা অনুযায়ী ভোগের জন্য স¤পদ সরবরাহে ঘাটতি পড়ে। মূল্যস্ফীতি ঘটে, স¤পদ প্রাপ্তিতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করে যে মানুষ সেই মানুষই ভোক্তার চাহিদা সৃষ্টি করে। উৎপাদনে আত্মনিয়োগের খবর নেইÑ চাহিদার ক্ষেত্রে ষোলআনা, টানাপড়েন তো সৃষ্টি হবেই। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেঁধে দেওয়া আছে কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে বাজার ভারসাম্য বিনষ্ট হবেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে স¤পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার যতগুলো কারণ এ যাবত আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এই স¤পদ অবৈধ অর্জনরোধে অপারগতা, অধিকার বর্জন এ প্রগলভতা এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।
সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা ঠুনকো কার্যকরণকে উপলক্ষ্য করে নেওয়া পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী ফল বয়ে আনে না। শুধু নিজের মেয়াদকালে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করলে, ধারাবাহিকতার দাবিকে পাশ কাটিয়ে ইতোপূর্বে গৃহীত কার্যক্রমকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার রেওয়াজ শুরু হলে টেকসই উন্নতির সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারীর, প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন হয়। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সকল সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সমস্যারা পর¯পরের মিত্র একটার সঙ্গে একটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয় উপার্জনের সকল কার্যক্রমের কার্যকরণগত স¤পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয় উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেওয়া। সমস্যার উৎসে যেয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারও একার নয়, এ কাজ সকলের। সমস্যার মোকাবিলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। বিগত ছয় দশকে এই ভূখ-ে যতগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা ধ্যানধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের কম-বেশি ব্যর্থতার পেছনে বিরুদ্ধ বাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতাই মুখ্য কারণ ছিল।
বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশের সম্পদশালীতায় ভাগ বসাতে এর সৌন্দর্যময়তায় মুগ্ধ হয়েই এখানে যুগে যুগে নানান বেশে বিদেশিবর্গীদের আনাগোনা ঘটেছে। এ মাটির মানুষেরা বিদেশিবর্গীদের সংমিশ্রণে মিশ্রিত মূল্যবোধের অধিকারী হয়েছে ফলে এখানকার সাধারণ একটি মামলা মোকদ্দমায়ও বিদেশিদের নাক গলাবার পথ সৃজিত হয়েছে। নিজেদের আত্মত্যাগের ফসলকে অন্যের অবদান হিসেবে পরিচিতি করণের সংস্কৃতি ও মানসিকতা সৃজিত হয়েছে। ভেতর থেকেই সেই সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নাম করে তোষণ পোষণের তরিকা যেমন বেরিয়ে এসেছে আবার উত্থিত বিরোধিতাকে বাইরের সাহায্য নিয়েই অবদমনের প্রয়াস চলেছে। ফলে এদেশের উন্নয়ন বারবার হোঁচট খেয়েছে পথে-ঘাটে ছড়ানো ছিটানো সংশয় সন্দেহের অবগঠিত ষড়যন্ত্রের নুড়ির আঘাতে। আর এভাবে আত্মঘাতি বাঙালি পদবাচ্যে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার ক্ষেত্রে নিজেদের তৎপরতায় তাদের কাটে অধিকাংশ সৃজনশীল সময়, মনোযোগে মন্দা আর উন্নয়নে ভাটা। সমূহ সম্ভাবনাময় হয়ে এসব আপদ-বিপদের সুদাসলে সঞ্চয় ভেঙে যায়, তৈলাক্ত বাঁশের মতো জিডিপির গ্রোথ বাড়ে-কমে, আত্মবিশ্বাসে ঘুন ধরে, আত্মমর্যাদা সংশয় সন্দেহের উঁইপোকায় খেয়ে ফেলে। এসব রোগ বালাই না থাকলে সুস্থ সবল দেহে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এত বিলম্ব ঘটত না। এসব অপঘাত, অপযাত্রা, অপবাদ, অপপ্রয়াস এড়িয়ে চলতে পারলে বাংলাদেশের জিডিপি, রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বাণিজ্য, প্রকৃত শিক্ষিতের হার, প্রশিক্ষিত শ্রমিক আর জনসম্পদ উন্নয়নের মাত্রা বর্তমানের চাইতে দ্বিগুণ হতে পারত নিঃসন্দেহে। জগত সভায় অন্যান্য অনেক সহযাত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটত সাফল্যের সামিয়ানার নিচে।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান