বঙ্গবন্ধু যেন কেবল পণ্য না হয়
মঞ্জুর”ল আলম পান্না
২০০১-এ বিএনপি যখন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসল, তারপর থেকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে নানামুখী চেষ্টা চলছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অনন্য সাধারণ উচ্চতায় তুলে ধরার। বিষয়টা এমন ছিল যে পারলে বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে তার স্থানে জিয়াউর রহমানকে বসানোর। তখন এসবের প্রতিবাদ যেমন হয়েছিল, অনেকের মাঝে বিষয়টা তুমুল হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছিল। সে সময় খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্যের একটি অসাধারণ কার্টুন প্রকাশ হলো প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। কার্টুনটি ছিল এ রকমÑ দীর্ঘংদেহী বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন তার পাহাড়সম ব্যক্তিত্বে, পাশে দাঁড় করানো হয়েছে জিয়াউর রহমানকে পায়ের নিচে কয়েকটা ইট দিয়ে। বোঝানো হচ্ছিলÑ শুধু শারীরিক গঠনের দিক থেকেও তাকে বঙ্গবন্ধুর সমান করা অনেক কষ্টসাধ্য। এটাই সত্য। হাজার বছর ধরে চেষ্টা করলেও বঙ্গবন্ধুকে তার ইতিহাসের সুবিশাল উচ্চতা থেকে কখনোই নামানো সম্ভব নয়। তবে ইতিহাস বিকৃতকারী তার শত্র”রা এ কাজটি না পারলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথিত অনুসারীরা মাঝে মধ্যেই তাকে খেলো করে তোলেন, সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর ব্যক্তিতে পরিণত করেন অবলীলায়। এ ধরনের বিপত্তিগুলো ঘটে চলেছে নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে চুনোপুটি থেকে শুর” করে বড় বড় নেতারা পর্যন্ত যখন বুঝে না বুঝে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন শুধুমাত্র চাটুকারিতার জন্য। তার সর্বশেষ উদাহরণ একটি শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে বরগুনা সদর ইউএনওর উদ্যোগে ব্যবহার পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায়। শোকের মাস আগস্ট চলছে। অনেক আগে থেকে শুর” হয়ে গেছে জাতির জনকের ছবির সঙ্গে নিজের দাঁত বের করা ছবি দিয়ে পোস্টার-ব্যানার সাঁটার প্রতিযোগিতা। শুধু আগস্ট মাস কেন, বিভিন্ন উপলক্ষ্য তৈরি করে সারাবছরই চলে এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা অন্যান্য দলের মতোই। রাজপথে সড়ক বিভাজক-ল্যাম্পপোস্ট-দেয়াল থেকে শুর” করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সম্মুখভাগ দখল করে, এমনকি মানুষের ঘর-বাড়ির প্রবেশ পথ কিংবা পাবলিক টয়লেটের সামনেও লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ ধরনের পোস্টার-ফেস্টুন-প্লাকার্ড-বিলবোর্ড। মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত, অতিষ্ঠ।
সকাল-বিকাল বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিলেই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা যায় না, তার ছবির সঙ্গে নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার সেঁটে দিলেই মহানায়কের আদর্শকে বুকে ধারণ করা যায় না। কথায় কথায় ‘বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন’র কথা শোনানোতে অনেকের কাছেই খেলো হয়ে উঠছেন ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান। এখন টি-শার্টে দেখা যায় বিপ্লবী চে গুয়েভারা, মাও সেতুং, কার্ল মার্ক্স, লেনিন, লালনসহ অনেক কিংবদন্তির ছবি। টি-শার্ট ছাড়াও এসব ছবি দেখা যায় আরও বিভিন্ন ধরনের পণ্যে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যারা এ ধরনের ছবি সম্বলিত পণ্য ব্যবহার করেন তাদের প্রায় পঁচানব্বই ভাগই ওইসব কিংবদন্তির সম্পর্কে একটা বাক্যও জানেন না। তারা ব্যবহার করছে কেবল ফ্যাশন হিসেবেই। আর ব্যবসায়ীরা তা তৈরি করছেন স্রেফ পণ্য হিসেবে। বঙ্গবন্ধুকেও এখন এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাতেও কোনো আপত্তি নেই। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে বিভিন্ন পণ্যে, স্যুভেনিরে দেশের ঐতিহাসিক এবং আকর্ষণীয় স্থান বা নিদর্শনের ছবি তুলে ধরার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ছবিও অবশ্যই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তাকে যেন কেবল পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে কেউ যেন রাজনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে, সাধারণ মানুষের কাছে যেন তিনি হাসির পাত্র না হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুকে কেবল দলীয় সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে যারা এই হীন কাজগুলো করছেন তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করা দূরে থাক্ তার আদর্শ সম্পর্কে দুটো লাইন বলতে পারবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে।
বিশ্ব যেখানে বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য তৃষ্ণার্ত-উদগ্রীব সেখানে আমরা অনেকটাই উদাসীন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ফারসি, জাপানি, জার্মানি, হিন্দি, আরবি, চীনা, ইংরেজি সেগুলোর অন্যতম। বইটির ইংরেজি অনুবাদক অধ্যাপক ফখর”ল আলম দুই বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেনÑ তখনই পাকিস্তানে বইটি সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় ছিল। আর দলীয় বৃত্তের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আবদ্ধ করে রাখা দল আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের হাজারে একজনও যে বইটি পড়ে দেখেননি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অনেককে দেখেছি বইটি কিনতে, তবে তা ড্রইংর”মের শো-কেসে সাজিয়ে রাখতে।
বঙ্গবন্ধুকে কেবল শো-কেসে, পোস্টারে, নির্বাচনি সাইনবোর্ডে, বক্তৃতার কথামালায় সাজিয়ে রাখার কারণেই পুরো জাতিকে ভুগতে হয় সীমাহীন এক রাজনৈতিক শূন্যতায়। বঙ্গবন্ধু অন্যান্য কথিত কোনো নেতার মতো পুতুল-পণ্য কিংবা সাইনবোর্ড নয়। বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম, যা নিয়মিত চর্চা করতে হয় সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি চিন্তায়, এমনকি ব্যক্তিজীবনে।
লেখক: সাংবাদিক/সম্পাদনা: আশিক রহমান