পবিত্র হজে কোন কাজটি কেন করা হয়!
ওমর শাহ
ইসলামী ইবাদতগুলোর মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিস অনুযায়ী হজকে সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে। (বোখারি : ২৫)। তবে হজের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজের রুহ বা হাকিকতের সঙ্গে। বিজ্ঞ আলেমদের থেকে বর্ণিত হজের এ রুহ বা হাকিকত নিচের পয়েন্টগুলো থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। ১. এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে হজের সফরে রওয়ানা হওয়া কাফন পরে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২. হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৩. এহরাম পরিধান করে পূত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্য লাব্বাইক বলা গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে। ৪. লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে বান্দা হজ বিষয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয় এবং বাধাবিগ্ন, বিপদাপদ কষ্ট-যাতনা পেরিয়ে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, একথা ব্যক্ত করে। ৫. এহরাম অবস্থায় সব বিধিনিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে, মোমিনের জীবন বল্গাহীন নয়। মোমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যেদিকে টান দেন সে সেদিকে যেতে প্রস্তুত। এমনকি স্বাভাবিক পোশাক-আশাক থেকে বিরত থাকেন, প্রসাধনী, আতর, স্নো ব্যবহার, স্বামী-স্ত্রী বিনোদন থেকে বিরত থাকেন। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বৈধ এমনকি অতি প্রয়োজনীয় জিনিসকেও ছেড়ে দিতে সে ইতস্তত বোধ করে না বিন্দুমাত্র। ৬. এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মোমিন ঝগড়াটে মেজাজের হয় না। মোমিন ক্ষমা ও ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। মোমিন শান্তিপ্রিয়। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সে পবিত্র ও সহনশীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ৭. বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মোমিন নিরাপত্তা অনুভব করে। কেননা, বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তায়ালা। (সূরা বাকারা : ১২৫)। সফরের কষ্ট-যাতনা সহ্য করে বায়তুল্লাহর আশ্রয়ে গিয়ে মোমিন অনুভব করে এক অকল্পিত নিরাপত্তা। তদ্রুপভাবে শিরকমুক্ত ঈমানি জীবনযাপনের দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনার পর মোমিন আল্লাহর কাছে গিয়ে যে নিরাপত্তা পাবে তার প্রাথমিক উদাহরণ এটি। ৮. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ মোমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম-সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা, নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ম্য কী তা আমাদের বুঝের আওতার বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) করেছেন। বুঝে আসুক না আসুক কেবল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণের জন্যই আমরা চুম্বন করে থাকি হাজরে আসওয়াদ। এ চুম্বন বিনা শর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আনুগত্যে নিজেকে উৎসর্গিত করার একটি আলামত। ওমর (রা.) হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার আগে বলেছেন, আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার কোনোটারই তোমার ক্ষমতা নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) কে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। (বোখারি : ১৫২০)। হাজরে আসওয়াদের চুম্বন, তাই, যুক্তির পেছনে না ঘুরে, আল্লাহ ও রাসুলের নিঃশর্ত আনুগত্যের চেতনা শেখায় যা ধর্মীয় নীতি-আদর্শের আওতায় জীবনযাপনকে করে দেয় সহজ, সাবলীল। ৯. তাওয়াফ আল্লাহকেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বোঝায়। অর্থাৎ একজন মোমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এক আল্লাহকে সব কাজের কেন্দ্র বানিয়ে যাপিত হয় মোমিনের সমগ্র জীবন। বায়তুল্লাহর চার পাশে ঘোরা আল্লাহর মহান নিদর্শনের চার পাশে ঘোরা। তাওহিদের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের চার পাশে ঘোরা। তাওহিদ-নির্ভর জীবনযাপনের গভীর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। আর সাত চক্কর চূড়ান্ত পর্যায়কে বোঝায়। অর্থাৎ মোমিন তার জীবনের একাংশ তাওহিদের চার পাশে ঘূর্ণায়মান রাখবে আর বাকি অংশ ঘোরাবে অন্য মেরুকে কেন্দ্র করে, এরূপ নয়।
মোমিনের শরীর ও আত্মা, অন্তর-বাহির সবটাই ঘোরে একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে যা পবিত্র কোরআনে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। (সূরা বাকারা : ২০৮)। ১০. আল্লাহ তায়ালা নারীকে করেছেন সম্মানিত। সাফা-মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত-মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে শ্রম-মেহনতের পর প্রবাহ পেয়েছিল রহমতের ফোয়ারা জমজম। সাত চক্করে সম্পূর্ণ করতে হয় সাঈ, যা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর রহমত-সাহায্য পেতে হলে সাত চক্কর অর্থাৎ প্রচুর মেহনতের প্রয়োজন রয়েছে। মা হাজেরার মতো গুটি গুটি পাথর বিছানো পথে সাফা থেকে মারওয়া, মারওয়া থেকে সাফায় দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন আছে। পাথুরে পথে সাত চক্কর, তথা প্রচুর মেহনত ব্যতীত দুনিয়া-আখেরাতের কোনো কিছুই লাভ হওয়ার মতো নয় এ বিধানটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় পরিষ্কারভাবে।
১১. উকুফে আরাফা কেয়ামতের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুনতে হবে অপেক্ষার প্রহর। সঠিক ঈমান ও আমলের অধিকারী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে আল্লাহর করুণায়। আর অবিশ্বাসীদের অনন্ত আজাব ভোগ করাতে শেকল পরিয়ে নেয়া হবে জাহান্নামের পথে।