
পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষ ও তর্পণ বিধি
া ধীরেন্দ্রনাথ বারুরী
বছরের ১২ মাসে ২৪টি পক্ষ রয়েছে, তার মধ্যে ২টি পক্ষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি পিতৃপক্ষ ও দ্বিতীয়টি দেবীপক্ষ। এই কৃষ্ণ পক্ষকে বলা হয় অপরপক্ষ কিংবা পিতৃপক্ষ। পিতৃপক্ষে স্বর্গত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পার্বণ শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করা হয়। যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে এ সময় পিতৃ পুরুষেরা আসেন। তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য তিল ও জল দান করা হয় এবং তাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদান করা হয়। অমাবশ্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবীপূজায় প্রবৃত্ত হতে হয়। তাই দেবীপূজার পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ, মহালয়া হচ্ছে পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং দেবী পক্ষের শুরুর পূর্ব দিন। পিতৃপক্ষে আতœসংযম করে দেবী পক্ষে শক্তি সাধনায় প্রবেশ করতে হয়। দেবী শক্তির আদিশক্তি, তিনি সর্বভূতে বিরাজিত। তিনি মঙ্গল দায়িনী করুণাময়ী। সাধক সাধনা করে দেবীর বর লাভের জন্য, দেবীর মহান আলয়ে প্রবেশ করার সুযোগ করেন বলেই এ দিনটিকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়ার পর প্রতিপদ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয়। বাংলাদেশ এবং কোলকাতায় ষষ্ঠ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয়। হিন্দুধর্ম মতে পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিতৃপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ নামেও পরিচিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম (শ্রাদ্ধ), তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হিন্দু হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তারা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়। মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা পিতৃলোকে গমন করলে, তাকে স্বর্ণ ও রতœ খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ যমরাজকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যমরাজ বলেন, কর্ণ সারাজীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই পিতৃলোকে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয় । পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান।
ড্রক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতাত্ত্বিক উষা মেননের মতেও, পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।বাংলায় মহালয়ার দিন দুর্গাপূজার সূচনা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিন দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চ-ীপাঠ করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করেন। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপ্রহরে নদী বা হ্রদের তীরে বা শ্রাদ্ধকর্তার গৃহে। অনেক পরিবার বারাণসী বা গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন। মৃত ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা পিতৃকূলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায় দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন। কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র পূর্ববর্তী এক পুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়। পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত রান্না করে রুপো বা তামার পাত্রে কলাপাতার উপর দেওয়া হয়। এই খাদ্যগুলো হলো ক্ষীর, লপসি, ভাত, ডাল, গুড় ও কুমড়ো। শ্রাদ্ধকর্তাকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে শ্রাদ্ধ করতে হয়। শ্রাদ্ধের পূর্বে তিনি কুশাঙ্গুরীয় (কুশ ঘাসের আঙটি) ধারণ করেন। এরপর সেই আঙটিতে পূর্বপুরুষদের আবাহন করা হয়। শ্রাদ্ধ খালি গায়ে করতে হয়, কারণ শ্রাদ্ধ চলাকালীন যজ্ঞোপবীতের অবস্থান বারংবার পরিবর্তন করতে হয়। শ্রাদ্ধের সময় সিদ্ধ অন্ন ও ময়দা ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পি-ের আকারে উৎসর্গ করা হয়। একে পি-দান বলে। এরপর দুর্বাঘাস, শালগ্রাম শিলা বা স্বর্ণমূর্তিতে বিষ্ণু এবং যমের পূজা করা হয়। এরপর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রদান করা হয়। এই খাদ্য সাধারণত ছাদে রেখে আসা হয়। যদি কোনো কাক এসে সেই খাদ্য খেয়ে যায়, তাহলে ধরা হয় যে খাদ্য পিতৃগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। মনে করা হয়, পাখিটি আসলে যম বা পিতৃগণের আত্মার প্রতিনিধি।
তর্পণ : তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো তৃপ + অনট। তৃপ ধাতুর অর্থ তৃপ্তি সাধন করা। এখানে তৃপ্তি সাধন বলতে দেব-ঋষি- পিতৃ-মনুষ্যগণের তৃপ্তিসাধনকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণভাবে মৃত পূর্বপুরুষগণকে জলদান করাকেই তর্পণ বলা হয়। মৃত পূর্বপুরুষ শব্দে যাদের সপি-ীকরণ (বাৎসরিক শ্রাদ্ধ) করা হয়েছে তাদের বোঝাবে। কিন্তু কোনো জীবৎপিতৃক (যার পিতা জীবিত আছে) ব্যক্তি তর্পণ করতে পারবে না।
আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের বংশধরগণের কাছে পি- ছাড়াও জলাকাক্সক্ষা করেন। কারণ হিন্দু শাস্ত্রানুসারে দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। তাই আমাদের পিতৃগণের দেহে যে আত্মা ছিলেন তিনি এখন যে শরীরেই অবস্থান করুন সেই শরীরেই জলক্রিয়া ও শ্রাদ্ধের দ্বারা তিনি তৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শাস্ত্রমতে তর্পণ জলের ও শাস্ত্রীয় দ্রব্যের পরমাণু অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা মন্ত্রবলে তার বর্তমান দেহের ভক্ষ্য বস্তুর পরমাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে। তাই দেব-ঋষি-পিতৃ-মনুষ্যগণের তর্পণ করলে তারা খুশি হন ও বিনিময়ে তারা আমাদের সুখ, সমৃদ্ধি, সাফল্য, পরিপাকশক্তির বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু দান করেন। তর্পণ প্রতিদিনই করা উচিত। কিন্তু নানা কাজে মানুষ ব্যস্ত থাকায় পিতৃপক্ষের পনেরো দিন তর্পণ করে থাকে। যারা তাতেও অক্ষম তারা মহালয়ার দিন তর্পণ করে। স্নানাঙ্গ-তর্পণ স্নানান্তেই করতে হয়। লেখক : সভাপতি, সনাতন ধর্ম মহাম-লী
