
সৃষ্টিকর্তা সাকার, নাকি নিরাকার
া শ্রী অক্ষয় লীলামাধব দাস
সৃষ্টিকর্তা সাকার হতে পারেন কি? সৃষ্টিকর্তার কথা বলতে গেলেই প্রথম যে কথাটি বলতে হয় তা হলোÑ তিনি সর্বতোভাবে পূর্ণ। ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ॥ (ঈশোপনিষদ, আবাহন মন্ত্র) তার মধ্যে কোনো অপূর্ণতা থাকবে না। তাই, যদি বলা হয় সৃষ্টিকর্তা কখনোই সাকার হতে পারেন না। তবে সেটা তার অপূর্ণতারই পরিচায়ক। আবার তিনি সর্বশক্তিমান। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সবকিছুর তিনিই নিয়ন্তা। তাই যদি তার কোনো রূপই না থাকে, তবে কি তাতে তার সর্বশক্তিমত্তা খর্ব হয় না? আবার, আরেক দিক থেকে, আমরা সকলেই সাকার, আমাদের রূপ রয়েছে, আমাদের পিতাদেরও রূপ রয়েছে, তার পিতাদেরও রপ ছিল, এটাই স্বাভাবিক। তবে যিনি সকলের আদি পিতা, তিনি কী করে রূপহীন হবেন? অবশ্যই তারও রূপ রয়েছে।
আবার, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তার সৃষ্টি অপেক্ষা কম গুণসম্পন্ন হবেন না। তাই ঈশ্বর, ভগবান, সর্বশক্তিমান, সৃষ্টিকর্তা যাই বলি না কেন, তিনি হবেন সর্বতোভাবে পূর্ণ তার মধ্যে কোনো কমতি বা অভাব থাকবে না। সেজন্য পূর্ণতা হেতু অবশ্যই তার রূপ থাকবে।
তিনি সাকার নিরাকার উভয়ই: তাহলে প্রশ্ন হয়Ñ তিনি কি নিরাকার নন? যদি তিনি নিরাকার না হন, তবে তিনি কীভাবে এ জগতের সর্বত্র বিরাজ করতে পারেন? আর যদি তিনি সাকারই হন, তবে কেন আমরা তাকে দেখতে পাই না?
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, যারা ভগবানকে কেবল নিরাকার নির্বিশেষ বলে দাবি করে, তাদের ধারণা ভুল নয়, অপূর্ণ।
কারণ, তারা এটাকেই মূল স্বরূপ বলে মনে করে। যেমন, কোনো ব্যক্তি (যিনি কখনো ট্রেন দেখেননি) দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখে মনে করতে পারে যে, ট্রেন এক প্রকার আলো। কিন্তু ব্যক্তিটি যখন প্লাটফর্মে ট্রেনটির কাছাকাছি যাবেন তিনি দেখতে পাবেন ট্রেন হচ্ছে কতগুলো কামড়ার সমষ্টি ও সর্পিলাকার একটি বৃহৎ যানবিশেষ। আবার যখন ভেতরে প্রবেশ করবেন বা ট্রেনে চড়বেন, তখন তার বাস্তব উপলব্ধি হবে যে, ট্রেন প্রকৃতপক্ষে কী বস্তু। একইভাবে নির্বিশেষবাদী বা নিরাকারবাদীরা মনে করে যে, ভগবানের নির্বিশেষ রূপই সবকিছু। এটা ঠিক দূর থেকে ট্রেনের আলোক দর্শনের মতো।
পরমত্ত্ব তিনভাবে উপলব্ধ হন: তবে তার নিরাকার স্বরপ কেমন? সাকার স্বরূপই বা কেমন? এ ব্যাপারে বেদান্ত সূত্রের মূল ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবতে (১.২.১১) ব্যাসদেব নিজেই প্রমাণ দেখিয়েছেনÑ
বদন্তি তত্তবিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞঅনমদ্বয়ং।
ব্্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ॥
‘যা অদ্বয় জ্ঞান, এক অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ প-িতেরা তাকেই পরমার্থ বলেন। এই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভাগবান Ñ এ তিন নামে অভিহিত হন।’
এখানে বলা হচ্ছে তিনি অদ্বয়, মানে তিনি দুই নন, এক। একমেব অদ্বিতীয়ম্। এই অদ্বিতীয় বস্তু তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হনÑ ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান। এখন প্রশ্ন হলো ব্রহ্ম কী?
ব্রহ্ম: ব্রহ্ম ভগবানের অঙ্গনিঃসৃত জ্যোতি এবং তা ভগবানের জ্যোতির্ময় স্বরূপ। যাকে আমরা নিরাকার বলে আখ্যায়িত করে থাকি। যে স্বরূপে তিনি সর্বব্যাপ্ত।
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদ-কোটি-
কোটিষ¦শেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্ ।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমশেষভূতং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪০)
‘যাহার প্রভা হইতে উৎপত্তি-নিবন্ধন উপনিষদুক্ত নির্বিশেষব্রহ্ম কোটিব্রহ্মা-গত বসুধাদি বিভূতি হইতে পৃথক হইয়া নিষ্কল অনন্ত অশেষ-তত্ত্বরূপে প্রতীত হন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।’
পরমাত্মা: যে স্বরূপে ভগবান প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন, তাকে বলা হয় পরমাত্মা। পরমাত্মা প্রসঙ্গে ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছেÑ
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ ॥
‘এই শরীরে আরেকজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাকে পরমাত্মাও বলা হয়।’
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরণ্যঃ পিপ্পলাং স্বাদ্বত্ত্য অনশ্নন্ন অন্যোহভিচাকশীতি ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৬)
‘একটি গাছে দুটি পাখি আছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি গাছে ফলগুলো খাচ্ছে, আর অন্যটি সেই কাজ লক্ষ্য করছে। লক্ষ্যকারী ভগবান এবং ফল ভক্ষণকারী জীবসত্তা।’
ভগবান: যে স্বরূপে তিনি তার নিত্য ধামে নিত্যস্বরূপে সর্বদা বিরাজ করেন, সেটা ভগবান স্বরূপ।
গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো
গোবিন্দমাদিপুরুষং ত্বমহং ভজামি ॥
‘যে অখিলাত্মভূত (সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থানকারী) গোবিন্দ নিত্য স্বীয় গোলোকধামে বাস করেন। সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।’
ভগবদ্গীতায় ভগবান তার ধাম অর্থাৎ তার আবাসস্থল সম্পর্কে বলছেনÑ
অব্যক্তেহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিং।
যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥
‘…কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।’
প্রকৃতপক্ষে, এমন নয় যে, ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবানÑ তিনটি আলাদা ব্যক্তিসত্তা। এই তিনটি স্বরূপ একই বস্তুর তিনটি প্রকাশ। তাদের মধ্যে সত্তাগত কোনো পার্থক্য নেই, কেবল প্রকাশজনিত পার্থক্য বিদ্যমান। তাই একে বলা হয় অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব।
দৃষ্টান্ত: রসমালাই একটি সুমিষ্ট আহার্য। প্রথমে আমরা তার গন্ধ অনুভব করতে পারি। তারপর গন্ধ শুকে এর কাছে যেতে পারি এবং তার রূপ দেখতে পারি এবং পরিশেষে তা আহার করতে পারি। রসমালাইয়ের গন্ধ, তার রূপ ও তার স্বাদ আলাদা নয় একই বস্তু থেকে উদ্ভুত। কেবল তিনটি পর্যায়ে রসমালাই সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। কেউ যদি কেবল গন্ধকে, কেউ কেবল গন্ধ ও রূপ দেখে আস্বাদন না করে, তবে সে রসমালাই সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারবে না। একইভাবে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান পরমত্ত্বের তিনটি রূপভেদ। ভগবৎস্বরূপ অস্বীকার করে কেবল ব্রহ্ম ও পরমাত্মার উপলব্ধি অসম্পূর্ণ।
তার মূল স্বরূপ সাকার, নিরাকার তার একটি প্রকাশ
নির্বিশেষ বা নিরাকারবাদীরা বলে থাকে ‘ব্রহ্মই সকল কিছুর উৎস। ব্রহ্ম থেকেই সকল কিছু প্রকাশিত হয়েছে। ব্রহ্ম যখন কোনো বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করেন, তখন তিনি কৃষ্ণ, বিষ্ণু আদি বিভিন্ন অবতাররূপে লীলা করেন। ব্রহ্ম নিরাকার। এই নিরাকার ব্রহ্ম থেকেই অন্যসব প্রকাশসমূহের সৃষ্টি হয়েছে।” কিন্তু তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত, অযৌক্তিক ও অশাস্ত্রীয়।
দৃষ্টান্ত: যেমন সূর্য সাকার। তার থেকে নির্গত রশ্মি ও তাপ নিরাকার। এখন প্রশ্ন হলো সূর্যরশ্মির উৎস সূর্য; নাকি সূর্যের উৎস সূর্যরশ্মি। আবার প্রদীপ থেকে শিখা নির্গত হয়, বাল্ব থেকে আলো নির্গত হয়। আলো এবং শিখা নিরাকার কিন্তু তার উৎস বাল্ব সাকার। শক্তিমান থেকেই শক্তির প্রকাশ হয়। তাই শক্তিমান সাকার কিন্তু শক্তি নিরাকার। একইভাবে ভগবানের শক্তি ব্রহ্ম নিরাকার কিন্তু ব্রহ্মের উৎস ভগবান সাকার।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে সূর্য বৃহৎ নাকি তার আলোকম-ল বৃহৎ। স্বভাবতই উত্তর হবে আলোকম-ল বৃহৎ। যেহেতু সূর্যের আলোকম-ল সূর্যের চতুর্দিকে বিস্তৃত; আপাতবিচারে মনে হতে পারে সূর্য অপেক্ষা সূর্যরশ্মির ব্যাপ্তি অধিক এবং তা আলোকম-লেরই অংশ।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে সূর্যের আলোক সূর্যেরই অংশ। তদনুরূপ যেহেতু ব্রহ্ম সর্বব্যাপী এবং ভগবানের নির্দিষ্ট আকার রয়েছে, তাই কেউ কেউ ভগবানকে ব্রহ্মের অংশ বলে মনে করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্রহ্মের উৎস স্বয়ং ভগবান। তাই ভগবান তার ব্রহ্মস্বরূপে সর্বত্র ব্যাপ্ত হলেও তা ভগবানেরই অঙ্গনিঃসৃত জ্যোতি।
অনেকের ধারণা যে, সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতপক্ষে নিরাকা ব্রহ্ম। ব্রহ্মই পরবর্তীতে রূপ বা ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছেন। তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কে ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছেÑ
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৭/২৪)
‘বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।’বিয়েতে অগ্নিদেবতাকে সপ্তবার
