‘মৃত্যু’কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম
এ্যমি তৃষিতা
‘মৃত্যু’ পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া। মৃত্যু কথাটি উচ্চারণ করতেই মনের ভেতর থেকে একটা অন্যরকম কষ্ট অনুভব হয়। কারো কাছে মৃত্যু বিষয়টা খুব সহজ, কারো কাছে কঠিন। কেউ এটাকে অনুভব করতে পারে, কেউ পারে না। তবে আমি আমার জীবনে ‘মৃত্যু’কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম এবং উপলব্ধিও করেছিলাম। যারা এ জীবনে তাদের খুব কাছের মানুষদের হারিয়েছেন তারাই বোঝেন বিষয়টা কতটা গভীর।
২০০৬ আমি তখন বেশ ছোট। এর আগে নিজের আপনজন কাউকে মারা যেতে দেখিনি।২০০৬ সালের ১৬ই অক্টোবর আমার বড় মামা মি.রেভা আলফ্রেড প্রদীপ ভট্টাচার্য, তিনি প্রভু যীশুর কোলে আশ্রয় নেন। অর্থাৎ আমাদের জাগতিক ভাষায় তিনি মারা যান। সেই দিন আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম কাউকে হারানো কতটা কষ্টের। পরিবারে একজন মানুষের অনুপস্থিতি কতটা বেদনার সৃষ্টি করে। মামার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর হসপিটালে বসে থাকা সেই মুহূর্তটা আমি কোন দিন ভুলবো না। সবাই কাঁদছে, আমিও কাঁদছি। একে একে অনেক ছোট খাট ঘটনা, অনেক স্মৃতি মনে পড়তে থাকে মামাকে ঘিরে। অনেকেই আমাকে শূটকী বলে ডাকে। তাদের মধ্যে একজন আমার বড় মামা। মামার সেই ডাক বার বার কানে ভাসতে থাকে আমার। আমার মনে পড়ে প্রতি বছর আম, কাঠালের সময় বড় মামার বাসায় পার্টি হতো। আমরা সব ভাই বোন একসাথে কত আনন্দই না করতাম। মামা এক গাদা ফল কিনে আনতো আর আমাকে পাশে বসিয়ে খাওয়াতো, আমি একটু কম খাই বলে। আরো মনে পড়ে প্রতি বছর বড়দিনের সময় আর কারো বাসায় দাওয়াত থাকুক না থাকুক বড় মামার বাসায় দাওয়াত থাকবেই। আগের বছর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ বড়দিন উপলক্ষে মামার বাসায় দাওয়াত ছিল। আমরা সব ভাই বোন মিলে অনেক আনন্দ করেছিলাম। সেই দিনটা বার বার মনে পড়ছিল ঐ মুহূর্ত। সেদিনও ভাবিনি আগামী বছর বড়দিনটা মামাকে ছাড়া করতে হবে। বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল মামা নেই। সেই দিনই মৃত্যুটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম আমি।
এরপর মাত্র ৪ বছরের ব্যবধান। আরো একবার চোখের সামনে মৃত্যুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। এ যেন এক ভয়ানক দৃশ্য। আমার ছোট মামা মি. অ্যাডবিন অনুপ ভট্টাচার্য। খুবই নির্জীব প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কারো সাথেও না পাঁচেও না। জীবনে কোনদিন বলে ডাকতেন না। সব সময় ‘মা’ বলে ডাকতেন। আজ সেই মা ডাক আমি ভীষন মিস করি। মামার একটা দারুন বৈশিষ্ট্য ছিল, সে খুব সুন্দর রান্না করতে পারতো। যখনই ভাল কিছু রান্না করতো সবার বাসায় এক বাটি করে পাঠিয়ে দিত। কোন কিছু খাওয়ার আগে সব সময় জিজ্ঞাসা করতো ‘তোরা খেয়েছিলি তো’, ‘তোদের আছে তো’, জানি না আর কেউ কখনো এভাবে জিজ্ঞাসা করবে কিনা।
ছোট মামার মৃত্যুটা একেবারেই আকস্মিক ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। যদিও তিনি প্রায় এক বছর ভীষন অসুস্থ ছিলেন। তবুও আমরা ভাবিনি তাকে এভাবে হারাবো। ১৩ই মে ২০১০ বৃহস্পতিবার। এর আগের দিন রাতে অসুস্থতার কারণে মামাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনের যাওয়াটাই ছিল আমাদের বাসা থেকে মামার শেষ যাওয়া। আমরা কেউ বুঝিনি এভাবে সবাইকে কষ্ট দিয়ে মামা চলে যাবে। পরদিন ১৩ তারিখ বিকাল ৪টায় দিকে শরীরের সমস্ত ব্যাথা, হৃদয়ের অব্যক্ত কষ্ট এবং পৃথিবীর এই বন্দিত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিরাজ, বিশ্রামদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্টের কোলে তিনি আশ্রয়নেন। আমার কেন জানি বিশ্বাসই হচ্ছিল না মামা আর নেই। বড় মামার মৃত্যুটা তবুও কোন রকমে ভুলেছিলাম। এই সান্তনা ছিল যে এক মামা নেই কিন্তু আর এক মামাতো আছে যাকে মামা বলে ডাকতে পারবো। মামার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরও আমার মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করছিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সবাই কাঁদছে, কিন্তু আমি কাঁদছি না। তখনও আমি অনুভব করতে পারছিলাম না কিছুই। ড্রইং রুমের মেঝেতে শুইয়ে রাখা মামার নিথর দেহটার দিকে এক পলক তাকালাম। আসলেই আমার মামা নেই। আর কোন দিন কাউকে ‘মামা’ বলে ডাকতে পারবো না, হঠাৎ করে মনে হতেই বুকের ভেতর থেকে একটা অন্য রকম কষ্ট অনুভব করলাম। এক ফোটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে আমার হাতের উপর এসে পড়ল। এই এক ফোটা জলে আমি এক সমুদ্র জল দেখতে পেলাম না যে আমার সান্তনা দিবে। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে গেল,‘এ অনন্ত চরাচরে, স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে, সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে, গভীর ক্রন্দন, যেতে নাহি দিব; হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’