সংযত আচরণে ইমানের পূর্ণতা
ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ
পৃথিবীতে ইসলামের সুমহান স্বাতন্ত্র ও সুদূরপ্রসারী বৈশিষ্ট্য এর সামাজিকতায়। সমাজ জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা ও আদর্শ চৌদ্দশ বছর পরও অন্য সব মত ও পথের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও কার্যকর।
ব্যক্তি ও পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে- সম্মিলিত মানব সম্প্রদায়ের যে বন্ধনে আমাদের বসবাস, এর স্থিতি, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজেকে সংযত রাখা।
যুগ যুগ ধরে এ পৃথিবীর ইতিহাসে ঝরে পড়া প্রতিটি রক্তফোটার উৎস মানুষের সীমালংঘন ও অসংযত আচরণ। যে যখন তার সীমা ছাড়িয়ে অন্যের সীমানায় আঘাত করেছে, চাই তা মুখের কথায় কিংবা শারীরিক শক্তি প্রদর্শনের বেলায়- সংঘাত ও দ্বন্দ্বের সূচনা সেখান থেকেই। একের অত্যাচারে তখন অন্যজন আহত হয়, অতিষ্ঠ হয়, বিক্ষুদ্ধ হয়। চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে অশান্ত। অস্থির হয়ে ওঠে চলমান সময়।
ইসলাম যে শুধু নামাজ-রোজা কিংবা ইবাদতের কিছু আদেশসমষ্টির নাম নয়, তা পবিত্র কুরআনের আয়াত ও নবীজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আমাদের পারস্পরিক আচার-আচরণের বিষয়ে অসংখ্য হাদীস থেকে খুব সহজেই স্পষ্ট হয়। আমরা কেউ যেন একে অপরের কষ্ট ও যন্ত্রণার কারণ না হই- এ নির্দেশ এবং এর বাস্তবায়ন দেখিয়েছে ইসলাম।
পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, যারা ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারীদের অযথা কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ এবং সুস্পষ্ট পাপ বহনকারী। সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক আরও বিস্তারিত আদেশ করছেন, হে ঈমানদাররা! তোমরা অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমান পাপের অন্তর্ভূক্ত। তোমরা একে অপরের গোপন বিষয়গুলো খুঁজে বেড়াবে না এবং একে অন্যের আড়ালে নিন্দা করবে না।
ইমাম মুসলিম হিশাম বিন হাকিম রা. এর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, দুনিয়াতে যারা মানুষকে কষ্ট দেয় আল্লাহ পাক তাদের অবশ্যই শাস্তি দেবেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নিজের গোলামকেও যদি বিনা কারণে সামান্য একবার লাঠি-চাবুক দিয়ে মারা হয়, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক নির্যাতিতের পক্ষে তার অধিকার ওই অন্যায় প্রহারকারীর কাছ থেকে আদায় করে নেবেন।
দ্বন্দ্ব-বিবাদের প্রথম সূচনা মুখ থেকে। তিরস্কার-কটুক্তি কিংবা নিন্দা-অপবাদ থেকে অনেক নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে যায়। আর তাই এক ইসলামের পরিচয়ে সব মুসলমানকে এক বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনের আয়াত, নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই। (সূরা হুজুরাত-১০)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই একই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এক ভাই যেন অন্য ভাইয়ের ওপর জুলম না করে, অপমান না করে, তুচ্ছ মনে না করে। (মুসলিম, আহমদ)
পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে মুসলমান সবাই যেন একটি দেহ। শরীরে একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে পুরো শরীর এর ব্যথায় কাতর হয়। (বুখারী, মুসলিম)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্টভাবে এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছেন। সংযত কথা ও শোভন আচরণকে ঈমানের পূর্ণতার মাপকাঠি বলেছেন। বিখ্যাত সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. এর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে মুসলমানের মুখের কথা ও হাতের কর্মকা- থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে- সে-ই তো প্রকৃত মুসলমান। (বুখারী ও মুসলিম)
বুখারি ও মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকের কাজ এবং কোনো মুসলমানকে হত্যা করা কুফুরীর নামান্তর। তিনি এমনও বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন একে অন্যের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা না করে।
শুধু আদেশ কিংবা নিষেধের বেড়াজালে নয় বরং পারস্পরিক ভালোবাসার মায়াবন্ধনে মুসলমানদের একতা ও অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক ছোট ও সামান্য বিষয়ের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অন্য মুসলমানের জন্য তোমার মুখের সামান্য মুচকি হাসি আল্লাহর কাছে সদকা হিসেবে গণ্য। অন্যের সাথে ভালোভাবে কথা বলা কিংবা তার বোঝা একটু এগিয়ে দিলে সেটিও সদকা হিসেবে বিবেচ্য। (বুখারী ও মুসলিম)