আন্তর্জাতিক চাপে ভীত নয় মিয়ানমার : সুচি
* শান্তি না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে * যাচাই-বাছাই করে পালিয়ে যাওয়াদের ফেরত নেওয়া হবে।
ইমরুল শাহেদ : মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সুচি মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, আন্তর্জাতিক চাপে ভীত নয় মিয়ানমার। মিয়ানমার সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। শান্তি না আসা পর্যন্ত সেনা অভিযান চলবে। আমরা শান্তি এবং ঐক্য চাই। যুদ্ধ চাই না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে দেশটির নেত্রী সুচি দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে অবশেষে জাতির উদ্দেশে এই ভাষণ দেন। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৪ মিনিটে টেলিভিশনে তার ভাষণটি সম্প্রচার হয়।
উল্লেখ্য, গত মাসে সহিংসতা শুরুর পর থেকে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সুচি বলেছেন, যারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে যারা পুনর্বাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন যে কোনো সময় তাদের সঠিক অবস্থান যাচাই করবে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর এই প্রথম জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সুচি বলেন, এই সংকট তৈরি হওয়ার আগেই আমরা নিশ্চিত করেছিলাম যে, সবার জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাখাইনে উন্নয়ন কর্মকা- শুরু হয়েছে। আমরা শান্তি এবং উন্নতি চাই। আমরা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং দেশে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।
রাখাইনসহ মিয়ানমারের সর্বত্র শান্তি নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন সুচি। তিনি বলেন, এতো মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে কেন যাচ্ছে সেটা তদন্ত করব আমরা। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করব যে তারা কেন এটা করছে।
তবে সুচি তার ভাষণে বারবার মুসলিম বললেও একবার রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি বলে গণমাধ্যমগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুচি বলেন, রাখাইনে অবস্থিত সব সম্প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করে মিয়ানমার। তিনি বলেন, আমরা শান্তি, স্থায়িত্ব এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরো বলেন, মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কাছে সমস্যার সমাধান চাচ্ছে। এই সংকট সমাধানে ১৮ মাস খুবই অল্প সময়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। প্রতিদিনই নতুন করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
সুচি বলেছেন, রাখাইনের সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে চায় তার সরকার। তবে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় এসেছে মাত্র ১৮ মাস হতে যাচ্ছে। এত অল্প সময়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছে, সেনাবাহিনী রাখাইনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, লোকজনকে হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার।
সুচি বলেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইন থেকে পালাননি এবং সেখানে সহিংসতাও শেষ হয়ে গেছে। অথচ গত বুধবার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জাও হাতে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর মধ্যে একশ ৭৬ টিতেই কোনো জনমানব নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, তার সরকার এই পরিস্তিতিতে কি করছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে চান তিনি। সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সুচি বলেন, রাখাইনে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
গত আগস্টে বেশ কয়েকটি পুলিশ চেক পোস্টে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনে সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সেনাবাহিনী। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতেই দেশ থেকে পালিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনের শামিল বলে উল্লেখ করেছে।
বেসামরিকদের উপর কোনো ধরনের অত্যাচার চালানো হয়নি বলে উল্লেখ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলছে, তারা ওই অঞ্চল থেকে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতেই অভিযান চালিয়েছে।
রাজধানী নাইপিডো থেকে টেলিভিশনের ভাষণে সুচি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। আমরা আমাদের দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন পুণরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে তেমন কিছুই বলেননি শুধু বলেছেন, সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ থেকে কোনো ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ বা জাতিগত নিধনের মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
তিনি বলেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে এটাই নির্দেশ করে যে পরিস্থিতি এতটাই তীব্র নয়।
ভাষণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন সুচি। টেলিভিশনে দেয়া ওই ভাষণে বারবার রাখাইনের মুসলিম শব্দটি উল্লেখ করলেও রোহিঙ্গা মুসলিম উল্লেখ করেননি শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেত্রী।
রোহিঙ্গা সঙ্কট, ১৯৯২ সালের চুক্তি
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দমন-পীড়নের ইতিহাস কয়েক যুগের পুরনো হলেও সাম্প্রতিক সঙ্কটের সূচনা হয় গত ২৪ অগাস্ট রাতে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলায় ১২ জন নিহত হওয়ার পর।
মিয়ানমার সরকার ওই হামলার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের নতুন এক বিদ্রোহী সংগঠনকে দায়ী করেছে। রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান এক সময় স্বাধীন রাজ্য থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শেষভাবে বার্মার রাজা ওই এলাকা দখল করে নেন; জাতিগত বিভেদ তখন থেকেই।
গত শতকের চল্লিশের দশকের পর আরাকানে বৌদ্ধ মগ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা লেগেছে। সামরিক শাসনামলে মিয়ানমারে ওই রাজ্যে চলেছে দফায় দফায় দমন অভিযান। রোহিঙ্গাদের বিভিন্নসংগঠন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথেও হেঁটেছে।
সহিংসতার কারণে গত শতকের আশির দশক থেকে চার লাখের মত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত অগাস্ট থেকে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অন্তত চার লাখ দশ হাজার।
বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি। সূত্র : জাগোনিউজ, বিডিনিউজ