যীশু খ্রিস্টের ১২জন শিষ্যের মৃত্যু বরণের ইতিহাস
ক্রাইষ্টবিডি
যীশুর মৃত্যু ও পুনুরুত্থানে পর প্রেরিতদের সবাই সুসমাচারের বার্তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছরিয়ে পরে। পবিত্র বাইবেলে যীশুর শিষ্যরা কোথায় ও কিভাবে মৃত্যু বরন করেন তার বর্ণনা খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে বাইবেলে শুধুমাত্র ২জনের মৃত্যুর কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে। তাঁরা হলেন যোহনের ভাই যাকোব ও ঈষ্করিয়োতীয় যিহুদা। অন্যান্য প্রেরিতদের মৃত্যুর ঘটনা চার্চ ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দলিল ও বিভিন্ন প্রতœতাত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত।
১. যাকোব (যিনি যিশুর ভাই ছিল): যাকোব (যিনি যিশুর ভাই ছিলেন) দামাস্কাস (বর্তমান সিরিয়া) তে প্রচার করেছিলেন। পরবর্তিতে তিনি জেরুশালেমে ফিরে আসেন এবং জেরুশালেমের খ্রিস্টিয় মন্ডলীর প্রথম নেতা ছিলেন। তাকে খ্রিস্টের বিশ্বাস অস্বীকার করতে বলা হলে তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে জেরুশালেম মন্দিরের দক্ষিণ চূড়া থেকে একশত ফুট নিচে ফেলে দেওয়া হয়। নিচে পড়েও তিনি জীবিত ছিলেন এটা বুঝতে পেরে তার শত্রুরা তাঁকে মুগুর বা গদা দিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। যাকোবকে যে চূড়া থেকে ফেলে দেওয়া হয় এটি সেই জেরুশালেম মন্দিরের দক্ষিণ চূড়া যেখানে শয়তান যীশুকে প্রলোভনে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
২. নথনেল হিসেবে পরিচিত বর্থলময়: যীশুর শিষ্য নথনেল হিসেবে পরিচিত বর্থলময়। তিনি মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক), পার্সিয়া (বর্তমান ইরান), তুর্কি ও আর্মেনিয়ায় প্রচারে গিয়েছিলেন। তিনি বর্তমান তুরস্ক নামক দেশের ঐতিহাসিক সাক্ষী। যীশুর শিষ্য নথনেলকে ডারবেন্ট,আজারবাইজান (রাশিয়ার কাছাকাছি অঞ্চল) সুসমাচার প্রচারের কারণে চাবুক দিয়ে শরীরের চামড়া তুলে ফেলার পর শিরোচ্ছেদ করা হয়। বর্থলময় মৃত্যুর আগেই সেখানকার বেশিরভাগ লোককে খ্রিস্টের অনুসারি করে তোলেন।
৩. শিমোন বা পিতর: শিমোন বা পিতরকে তার নিজের অনুরোধে উল্টোভাবে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ তিনি নিজেকে প্রভু যীশু যে ভাবে ক্রুশে মরেছেন সেই একইভাবে মরারও যোগ্য মনে করেন নি। ৬৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট নিরো শাসনামলে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। ক্রুশে মৃত্যুকালে তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। তার পবিত্র সমাধি ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স প্রাসাদে রয়েছে। যীশুর নিজের মুখেই প্রেরিত পিতর এর মৃত্যুর ব্যাপারে যীশু কি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন (দেখুন যোহন ২১:১৮-২০ পদ)।
৪. পৌল: প্রেরিত পৌলকে নির্যাতন এবং তারপর শিরোচ্ছেদ করা হয়। পিতরের মত তিনিও ৬৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট নিরো শাসনামলে তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। প্রেরিত পৌল এর শেষ চিঠি (২য় তীমথিয় ৪ অধ্যায়) থেকে আরও ধারণা পেতে পারেন।
৫. ফিলিপ: ফিলিপ ৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে গ্রীস, সিরিয়া ও ফ্রিজিয়া প্রভৃতি স্থানে সুসমাচার প্রচারের কাজ করেন। ফিলিপকে সাপের পুজারিদের সাথে মতের অমিলের কারনে প্রথমে পাথর ছুরে পরে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
৬. মথি: মথিকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করা হয়। ইথিওপিয়ায় তিনি খ্রিস্টের জন্য দুঃখ-ভোগ ও মৃত্যুবরন করেন।
৭. যাকোব: হেরোদ রাজা যাকোবকে তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে হত্যার নির্দেশ দেন (প্রেরিত ১২:২)।
৮. শিমোন: শিমোন মিশর এবং পরবর্তিতে পারশ্য (বর্তমান ইরান) এ প্রচার করেন। তাঁকে ৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল।
৯. যোহন: যোহন ছিল যীশুর একমাত্র শিষ্য যিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পাটমস্ দ্বীপে পাথর ও স্লেট এর খনি ছিল যেখান থেকে রোম সাম্রাজ্যের জন্য দালান-কোঠা নির্মানের সামগ্রী সরবরাহ হতো। পাটমস্ দ্বীপটি ছিল রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় কাজে আটক বন্দি ও ক্রীতদাসদের আবাসস্থল। তাকে একবার ফুটন্ত তেলে ফেলে দেওয়া হয়, কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। যোহনকে রোমে সুসমাচার প্রচারের দায়ে বন্দি করে এখানে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছিল যেন তিনি রোমে যীশুর সত্য প্রচার করতে না পারেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে পাটমস্ দ্বীপে বৃদ্ধ হয়ে মারা যান তখন তার বয়স আনুমানিক ৯০ বছরের বেশি ছিল।
১০.আন্দ্রিয়: আন্দ্রিয়কে গ্রীসে একটি এক্স-আকৃতির ক্রুশে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি জর্জিয়া (তখন রাশিয়া), ইস্তাম্বুল (তুর্কি), মেসিডোনিয়া ও গ্রীসে প্রচার করেছিলেন। গ্রীসের সম্রাট এজিয়াটিস এর পরিবারের সবাইকে খ্রিস্টের অনুসারি করার কারণে সম্রাট ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে ক্রুশে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। সাত জন সৈন্য তাকে গুরুতরভাবে চাবুক মারে তারপর তারা তাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ক্রুশের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। ক্রুশের উপর নিদারূন যন্ত্রনার মাঝেও তিনি বলেন,‘আমি এমন শুভ সময়ের জন্য দীর্ঘ্য আকাক্সিক্ষত ছিলাম, যীশুর দেহ ক্রুশে ঝোলার মাধ্যমে ক্রুশকে তিনি পবিত্র করেছেন।’ আন্দ্রিয় ক্রুশের উপর দুই দিন (মতান্তরে ৩ দিন) জীবিত থেকে সত্য যীশুর সুসমাচার প্রচার করেছিলেন। মৃত্যুর আগে ক্রুশে যন্ত্রনাভোগের মধ্যেও তিনি অনেককে যীশুকে গ্রহন করতে সাহায্য করেছিলেন। তার দেহাবশেষের অংশগুলি কনস্টান্টিনোপল (তুরস্ক) , স্কটল্যান্ড (ইংল্যান্ড) এ আছে, কিন্তু তার খুলিটি পেত্রাস এ রয়েছে।
১১. থোমা: প্রেরিত থোমা ভারতবর্ষে সুসমাচার প্রচারে এসেছিলেন। ৫২ খ্রিস্টাব্দে থোমা ভারতের কেরালার ক্র্যাঙ্গানোর আসেন। তিনি কেরালার ত্রিচূড় মহাকুমা এর পালায়ার গ্রামে প্রথম একজনকে খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষীত করেন। পরবর্তীতে থোমা পূর্ব উপকূলের দিকে চলে যান এবং ৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) বসতি স্থাপন করেন।
পরে চীন পরিভ্রমণ করে আবার চেন্নাইয়ে ফিরে আসেন। তারপর তিনি একটি গ্রামে বসবাস করেন যেটার বর্তমানে নাম মাইলাপুর। ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্থানীয় রাজা মাসদাই এর প্রধান পুরোহিতের ক্রোশানলে পরেন। কারন তারা জানতে পারে খ্রিস্টিয়ান ধর্মে বর্ণপ্রথা সমর্থন করে না। তখন তিনি পার্শবর্তী পাহারে আশ্রয়নেন কিন্তু প্রার্থনারত অবস্থায় তাকে বর্শার আঘাতে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে পাহারটি তার নামানুসারেই নাম রাখা হয় সেন্ট থমাস মাউন্ট । এখানে একটি গুহা আছে যেখানে থোমা বাস করতেন।
১২. বিশ্বাসঘাতক ঈষ্করিয়োতীয় যিহুদা: যীশুর মৃত্যু ও পুনুরূত্থানে কিছু কাল পরেই বিশ্বাসঘাতক ঈষ্করিয়োতীয় যিহুদা যিনি যীশুকে ৩০টি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে রোমান সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে (মথি ২৭:৫)। তিনি ফাঁসিতে ঝোলার সময় নিচের দিকে মুখ করে মাটিতে পড়ে যায় ও পেট ফেঁটে নাড়ী-ভুঁড়ী বের হয়ে গিয়েছিল (প্রেরিত ১:১৮-১৯)। খ্রিস্টিয় জীবনে প্রেরিতগন কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারা কোন বিশ্বাসের জন্য মরতে ইচ্ছুক ছিল। তখনকার সময়ে এত প্রতিকুলতার মধ্যেও জগতের জন্য যীশুর যে সত্য সুসমাচার তা প্রচারে অনিহা প্রকাশ করেননি। এমনকি তারা যীশুর সত্য হৃদয়ে ধারন করে আমাদের কাছে সেই সত্য পৌঁছে দিয়েছেন। তারা সত্যিই যীশু খ্রিস্টের পুনরুত্থানের সাক্ষী ছিল। তারা তা প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।