তনময় সরকার
নদীমাতৃক সভ্যতায় এক বিশেষ তিথিতে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করার অর্থ ছিল পরস্পরাকে ভবিষ্যতের দিকে বইয়ে নিয়ে যাওয়া। শরতের বিষুবদিবসেই অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে এই তর্পণ। মহালয়ায় পিতৃতর্পণ এক অতি প্রাচীন প্রথা। আর্যসভ্যতার প্রায় আরম্ভ থেকেই, অর্থাৎ সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে আর্যদের বসবাসের কিছুকাল পর থেকেই এই প্রথার সূত্রপাত ঘটে বলে বিশ্বাস করেন ইতিহাসবিদরা। নদীমাতৃক সভ্যতায় এক বিশেষ তিথিতে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করার অর্থ ছিল পরম্পরাকে ভবিষ্যতের দিকে বইয়ে নিয়ে যাওয়া। শরতের বিষুবদিবসেই অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে এই তর্পণ। পিতৃপুরুষের স্মরণে নিবেদিত এক পক্ষকাল চিহ্নিত হতে থাকে ‘পিতৃপক্ষ’ হিসেবে। মহাকাব্য ‘মহাভারত’ এক অনবদ্য কাহিনি বর্ণনা করে তর্পণ বিষয়ে। এই কাহিনি অনুসারে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে মহাবীর কর্ণের মৃত্যু হলে দাতা হিসেবে খ্যাত এই মহাত্মা স্বর্গে গমন করে নয় সেখানে তাকে খাদ্য হিসেবে সোনা, রুপো ও রতœ প্রদান করা হয়। কর্ণ বিস্মিত হন এবং দেবগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তার প্রতি এই আচরণের অর্থ কী। দেবরাজ ইন্দ্র (কোনো কোনো জায়গায় এই দেবতা যম) তাকে জানান, দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ-রৌপ্য-রতœাদি দান করে এসেছেন। কিন্তু কখনো তার প্রয়াত পিতৃপুরুষকে অন্নজল দান করেননি। কর্ণ দেবরাজকে জানান, তিনি অধিরথ নামক ব্যক্তির গৃহে প্রতিপালিত। তার প্রকৃত পিতৃপুরুষের পরিচয় তিনি জানতেন না। সেই কারণেই তিনি কখনো শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করতে পারেননি। তখন দেবরাজ তাকে অনুমতি দেন মর্ত্যে ফিরে আসতে এবং শ্রাদ্ধকা- সম্পন্ন করতে। কর্ণ মর্ত্যে ফেরেন এক পক্ষকালের জন্য। এবং এই পর্বে তিনি পিতৃপুরুষকে অন্নজন দান করেন। এই পক্ষকালই ‘পিতৃপক্ষ’ নামে পরিচিত হয়। কর্ণের কাহিনি করুণ। কিন্তু এর মধ্যে মিশে রয়েছে এক অজ্ঞাতকুলশীল ভারতীয়ের পিতৃপরিচয় লাভের আর্তি। এই কাহিনি তাই চিরন্তন। ইতিহাসের সঙ্গে এই কিংবদন্তিকে মিশিয়ে পাঠ করলে এক আশ্চর্য় সমগ্র উঠে আসে। যা হয়তো ভারতীয়ত্বের সারাৎসার।