দুর্গা পরিবার
বিনয় ভূষণ জয়ধর শিব
প্রলয়কর্তা অর্থে ঈশ্বরের নাম শিব। কিছুকাল না গেলে কোনো বস্তুর ধ্বংস অসম্ভব। তাই শিবকে কাল ও মহাকালও বলা হয়। যিনি সব কিছুর ধ্বংসকর্তা তার আবার ধ্বংস কী? সুতরাং শিবের একটি বিশেষ নাম মৃত্যুঞ্জয়। বিশ্বকে ঈশ্বরের শরীর বলা হয়েছে। শিবোপাসকগণ মনে করেন ও সাধারণতও এই বিশ্বাস প্রবল দেখা যায় যে, মহাদেবের ললাটে ও মানুষের চোখের মতো তিনটি চোখ আছে। বাস্তবিক তা নয়। সূর্য, চাঁদ ও আগুনই মহাদেবের তিন চোখ, তাই তিনি ত্রিলোচন। যথা, শঙ্করাচার্য-কৃত অপবাদভঞ্জন স্তোত্রে ‘বন্দে সূর্যশশাঙ্ক বহ্নিনয়নং’ ইত্যাদি। তিন চোখ তিন রকমের বলে মহাদেবের এক নাম বিরুপাক্ষ। জীর্ণদশায় প্রলয় ঘটে ও কালের বয়স অপরিমেয় বলে মহাদেবের মূর্তি বুড়ো মানুষের শরীরের মতো কল্পিত হয়েছে, তাকে প্রায় সর্বদা বৃদ্ধ বলে বর্ণনা কর হয়। চিতাভস্ম, শ্মশান ও নরমু- প্রভৃতি ধ্বংস বা মৃত্যুর স্মারক বলে ওই সবের দ্বারা তাকে দেখা হয়েছে। ধ্বংসকর্তা স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়, সুতরাং তার মৃত্যুঞ্জয়ত্ব দেখানোর জন্য তিনি বিষধর সর্পজড়িত বলে বর্ণিত। মহাদেবরূপী কাল ও জড়জগৎরূপী প্রকৃতি সংযোগেই সব কিছুর উৎপত্তি হয়, সুতরাং মহাদেব ও দুর্গাকে জগতের পিতা ও মাতা বলা হয়েছে। কালিদাস বলেছেন ‘জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।’ এই জন্য শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্টেরও কল্পনা। শবশিবারূঢ়া কালীমূর্তি, শক্তিহীন হলে শিবের যে অবস্থা ঘটে তা দেখানোর জন্য কল্পিত হয়েছে। কালী মহাদেবের শক্তি, সুতরাং শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে এলে শিব শক্তিহীন হয়ে শবের মতো পড়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য আনন্দলহরীতে বলেছেন, ‘শিবঃ-শক্ত্যা-যুক্তো ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং। নচদেবং দেবোনখলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি।’ অর্থাৎ, শিবের প্রভাব শক্তিযুক্ত থাকলেই; নয়তো তাহার নড়াচড়ার শক্তিও থাকে না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খ-েও ওই কথা আছে। ‘শিবশক্তস্তয়া শক্ত্যাশবাকার স্তয়া বিনা।’ অর্থাৎ, শিব শক্তিসহ থাকলেই শক্তিমান, নচেৎ শবাকার হন। মহাদেবকে বৃষবাহন বলার তাৎপর্য্য এই যে, কালের গতি বৃষভের গতির মতো ধীর অথচ নিশ্চিত। মেঘই মহাদেবের জটাজুট, সুতরাং শিবজটা থেকে গঙ্গার নির্গম হয় এর অর্থ এই যে, মেঘ থেকে জল নির্গত হয়। মহাদেবকে ভোলামহেশ্বর ও ধুস্তরফলাদি ভক্ষণকারী বলার তাৎপর্য এই যে, কালকে অনেক সময় মদবিহ্বল ব্যক্তির মতো কাজ করতে দেখা যায়। যেমন দুর্যোধনের রাজ্যভোগ ও যুধিষ্ঠিরের বনবাস প্রভৃতি। মহাদেব বৃদ্ধ কিন্তু উমা নিত্যযৌবনা, এর তাৎপর্য এই যে সময় একবার গেলে আর ফেরে না এবং তার বয়সেরও অন্ত নেই। কিন্তু পৃথিবী প্রতি বছর অভিনব বেশ ধারণ করে ও একবার বসন্ত শেষ হলেও তা বার বার আসতে থাকে।
কাল শূন্যের অনুরূপ ও আচ্ছাদনবিহীন বলে তাকে শ্বেতকায় ও দিগম্বর বলা হয়েছে। মহাদেবকে আদিদেব বলার তাৎপর্য এই যে, সবার আগেও কাল বিদ্যমান ছিল। সবই কালে ঘটছে। সুতরাং মহাদেব সর্বজ্ঞ, কালেই জ্ঞানলাভ হয়, সুতরাং তিনি জ্ঞানদাতা, এবং যশস্বী মহাত্মাদের কাল বাঁচিয়ে রাখে, সুতরাং তিনি ভক্তমু-মালী। মহাভারতে সুরথ সুধন্বার মু-গ্রহণ করার জন্য মহাদেবের যে আগ্রহ বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁকে ভক্তমু-মালী শব্দের বাচ্য করে তুলেছে বলতে হবে।
অনন্ত বা শূন্যের বলরামরূপ কল্পনা করে কালের কল্পিতরূপ মহাদেবের সদৃশ করা হয়েছে। একটি মনোহরশায়ী গানেও বলা হয়েছে, ‘তার পর একজন বৃষভেতে আরোহণ, দাদা বলাইর মতন।’ বাস্তবিক বলরাম ও মহাদেবের রূপে বিলক্ষণ সাদৃশ্য আছে। অনন্ত কাল অনন্ত আকাশের সদৃশ্যই বটে। শাস্ত্রে অনেক জায়গায় শিব ও দুর্গাকে পুরুষ ও প্রকৃতিও বলা হয়েছে।
রুদ্রের আট রকম শরীরের বর্ণনাও আছে। যথাÑ সূর্য, জল, পৃথিবী, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, দীক্ষিত ব্রাহ্মণ ও চন্দ্র। দীক্ষিত ব্রাহ্মণের বদলে কোনো কোনো স্থলে জীব লেখা হয়েছে।