দুর্গাপূজার প্রতীকী তাৎপর্য
কৃষ্ণকান্ত বৈরাগী
দুর্গা প্রতিমা ও তার সঙ্গের দেব-দেবীরা প্রতীকী উপস্থাপনা। প্রত্যেক ধর্মে প্রতীকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু হিন্দুধর্মে প্রতীক ব্যবহার এক বিশিষ্টতা লাভ করেছে। হিন্দুরা শব্দ, রেখাচিত্র, প্রতিমা ইত্যাদির মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করে। যোগশাস্ত্রে আমাদের দেহকে মন্দির এবং বিভিন্ন দৈহিক ক্রিয়াকর্মকে দেবতার আরাধনা হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রতীকী উপস্থাপনার এই সমৃদ্ধ দৃশ্যপটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবে হিন্দুধর্মে দুর্গামাতৃকার সঙ্গে পূজিত অন্যান্য দেব-দেবীর নানা প্রকার আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও লৌকিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই ব্যাখ্যার বিচিত্রতা, এই ধর্মের উচ্চ কল্পনাশক্তি ও চিন্তার গভীরতার নিদর্শক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñ দুর্গা, যিনি পরম সত্য, তার উপলব্ধি অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তিনি সর্বদুর্গতিনাশিনী, তাই নিম্নস্তরের প্রবৃত্তিসমূহের প্রতীক মহিষাসুরের সঙ্গে তিনি যুদ্ধরতা। দেব-দেবীদের পুঞ্জীভূত মিলিত শক্তির ফলে দুর্গামাতৃকার আবির্ভাব। জগতে সব শক্তিই এইভাবে সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা উদ্ভূত হয়। তার দশ হাতের দ্বারা তিনি সমস্ত দিক ও জীবনের সমস্ত ব্যাপারই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। দেবী-মাতৃকার বোধন অথবা দেবীর জাগরণ সাধকের সুপ্ত দৈবী সত্তার জাগরণ অথবা যোগীর কু-লীকৃত শক্তির উত্থান সূচিত করে। বিল্ববৃক্ষ, যেখানে দেবীকে আবাহন করা হয় তা সুষুম্নানাড়ি অর্থাৎ কু-লিনী শক্তির যাত্রাপথের প্রতীক। নানা গাছ-গাছড়ার সমাহারে সৃষ্ট ‘নবপত্রিকা’ তার সর্বভূতে অবস্থিতির পরিচায়ক। তার আরাধনায় বিভিন্ন নদী ও স্থান থেকে জল আহরণ করা হয় যা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ভাল ও মন্দ নানাবিধ জিনিসই পূজার উপচারে ব্যবহৃত হয় যা তার সমদর্শিতার পরিচায়ক, কারণ সমগ্র জীব জগৎ তার থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
গণেশ সিদ্ধিদাতা, কার্তিক শক্তিমান, লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও মহিমার প্রতিভূ এবং সরস্বতী জ্ঞানদায়িনী। তাদের বাহনদেরও বিশেষ অর্থ আছে। সিংহ মহাশক্তির বাহক। পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগের দ্বারা জীব বলশালী হয়। গণেশের বাহন ইঁদুর সূচিত করেÑতীক্ষণবুদ্ধির দ্বারা মায়ার বন্ধন পাশ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। দেব সেনাপতি কার্তিকের বাহন ময়ূর আমাদের জাতীয় পক্ষী। তার নানাবর্ণের পালক সূচিত করে যে পরিপূর্ণ সাফল্যের জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। লক্ষ্মীর বাহন দিবান্ধ পেঁচা যেন ধনদৌলতের অধিদেবতা, আবার সে জাগতিক বিষয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন সাধকেরও প্রতিভূ। সরস্বতীর বাহন রাজহংস বিশেষ ক্ষমতা বলে জল থেকে দুধ বা অবস্তু থেকে বস্তু পৃথক করতে পারে। লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুজনেই পদ্মের ওপর দ-ায়মান, এর তাৎপর্য হল আত্মনিবেদন, যার মাধ্যমে এই বিশ্বের সৃষ্টি। চক্র হল এই বিশ্বেরই চক্রের প্রতীক। প্রজ্জ্বলিত দীপ যেন আত্মজ্যোতির প্রতীক। যে পাঁচটি উপকরণ আন্দোলিত করে দেবীর আরতি করা হয় তা বিশ্ব প্রপঞ্চের মূল পাঁচটি উপাদানের প্রতিভূ। দীপ অগ্নির, শঙ্খস্থিত জল জলের, বস্ত্র ব্যোমের, ফুল মৃত্তিকার এবং চামর বায়ুর দ্যোতক। এইভাবে বিভিন্ন প্রতিমার প্রত্যেকটি এবং দুর্গাপূজার উপকরণগুলির প্রতীকী ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সামাজিক প্রভাব :
দেবী-মাতৃকা বা শক্তির আরাধনা সমাজের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলা দেশে এর প্রভাবে দেবী-মাতৃকার ওপর মহান সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত ও আরও অনেক শাক্ত সাধক অনেক মর্মস্পর্শী গান রচনা করেছেন, যেগুলি শাক্ত পদাবলি নামে পরিচিত। দেবী-মাতৃকাকে এই গানগুলিতে কেবলমাত্র মাতৃরূপই দেখা হয় না, তাকে কন্যা হিসাবেও কল্পনা করা হয়। এগুলি অত্যন্ত মানবিক ও হৃদয়গ্রাহী আগমনি গান হিসাবে পরিচিত। শাক্ত মতবাদের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় দিক হলÑ স্ত্রীশক্তিকে বিশেষ সম্মান দান। ‘সর্ব্বোল্লাস’ তন্ত্রে বলে ‘স্ত্রী সকল দেবতা, তারাই প্রাণবায়ু’। শ্রী শ্রী চ-ীতে বলে, ‘তুমিই নারী, তুমিই পুরুষ’। তন্ত্রে নারীকে গুরু হিসাবে মর্যাদা দেয় যা অন্যান্য মতবাদে দেওয়া হয় না। তান্ত্রিক সাধকদের বলা হয় সর্বপ্রকার বিভিন্নতা ভুলে নারী জাতিকে মাতৃ-জ্ঞানে প্রণাম করবে। নারী শক্তিকে স্বয়ং দেবী জ্ঞানে আরাধনার বিরাট সামাজিক মূল্য আছে। পাশ্চাত্যে খ্রিস্টধর্মে মাতা মেরির আরাধনার সূচনা হওয়ার পর নারীদের অবস্থা উন্নীত হয়। কিন্তু, মূলত তা যৌবন ও সৌন্দর্যের পূজা