মহামায়ার আরাধনা শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা
স্বামী স্থিরাত্মানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রত্যেক ধর্মেরই তিনটি দিক আছে। দর্শন, পুরাণ ও অনুষ্ঠান। দর্শন হল তত্ত্ব বা আসল রহস্য। পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করা হয়। আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরও স্থূল করে বুঝানো। দুর্গাপূজার তত্ত্বই বা কী আর এর পৌরাণিক কাহিনীই বা কী, তা জানার আগ্রহ আমাদের সকলেরই আছে। গল্পের আকারে বললে আমাদের বুঝতে সহজ হয়।
শ্রী শ্রী চ-ী গ্রন্থকে দেবীমাহাত্ম্য বলা হয়ে থাকে। দেবীর মাহাত্ম্য অর্থাৎ তাঁর মহিমা—-আমাদের জানা খুব দরকার। গীতায় ভগবান বলেছেন—নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ। মোঢ়োহয়ং নাভিজানাতি মামজমব্যয়ম্॥ (গীতা-৭/২৫) অর্থাৎ, সত্ত্ব, সজঃ ও তমোগুণ স্বরূপ ত্রিগুণাত্মক মায়ায় আমি আবৃত থাকি বলে সকলের কাছে প্রকাশিত হই না। কেবল কোনো কোনো ভক্তের কাছে আমি প্রকাশিত হই। আমার স্বরূপ জন্ম-মৃত্যুশূন্য। এই জগৎ মায়ামোহে অন্ধ। সেই জন্য জগতের মানুষ আমার স্বরূপ জানতে পারে না। উপমায় বলা হয়েছে—সামনে লক্ষ্মণ জীবাত্মা, পেছনে রাম পরমাত্মা, আর মাঝে মহামায়া সীতা। সীতা একটু সরে না গেলে লক্ষ্মণরূপ জীব রামরূপ পরমাত্মাকে দেখতে পায় না। ভগবান যে মায়ার কথা বলেছেন, তার প্রভাব জানতে পারলে আমরা তাঁকে প্রসন্ন করে মুক্ত হতে পারি। ঈশ্বরলাভ করে জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারি। নইলে মনুষ্য জীবনলাভই ব্যর্থ হয়ে যায়। মহামায়ার আরাধনার মাধ্যমে আমরা চিত্ত শুদ্ধ করে পরম ঈশ্বরের কৃপা লাভ করতে পারি। এখানেই শ্রী শ্রী দুর্গাপূজার সার্থকতা। মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে, সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গাপূজা করেছিলেন। সুরথ রাজাকে একবার শত্রুসৈন্যরা যুদ্ধে পরাজিত করল। তিনি নিজের রাজ্যে আছেন। কিন্তু এখানেও তার লোভী, দুষ্ট ও বলবান রাজকর্মচারীরা রাজার রাজকোষ দখল করল। সৈন্যবাহিনীরও কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। রাজা সুরথ হরিণ শিকার করবার ছলে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে বনে চলে এসেছেন। সে বনে বাঘ-সিংহ এসব হিংস্র পশুরাও খুব শান্তস্বভাব—হিংসা করে না। কারণ সেখানে আছে এক আশ্রম। আশ্রমে আছেন এক মুনি ও তাঁর শিষ্যরা। সে মুনির নাম মেধস মুনি। সুরথ রাজাকে মেধস মুনি খুব সমাদর করলেন। রাজা মুনির আশ্রমে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে কাটালেন। তার মন বড় খারাপ। তাঁর দুশ্চিন্তা হল—তাঁর রাজ্য পূর্বপুরুষরা রক্ষা করেছেন, আর তিনি তা পরিত্যাগ করে এসেছেন। দুষ্ট কর্মচারীরা ধর্ম অনুসারে রাজ্য পরিচালনা করছে কিনা। তার প্রিয় মহাবল হস্তিবাহিনী কী ঠিকমত খাদ্য পাচ্ছে? যে সব কর্মচারী রাজার কাছ থেকে পুরস্কার, ভোজন, বেতন ইত্যাদি পেয়ে রাজার অনুগত ছিল—-তারা এখন অন্য রাজার চাকর হয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে রাজকোষে যে ধন তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, তাও তার দুষ্ট কর্মচারীরা তাড়াতাড়িই শূন্য করে ফেলবে। রাজা এসব অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
এমন সময় রাজা সুরথ আশ্রমের কাছেই এক বৈশ্যকে দেখলেন। তিনি হলেন সমাধি বৈশ্য। রাজা জিজ্ঞেস করলেন—তিনি কে? এখানে তিনি কেন এসেছেন? তার মন খারাপ কেন? তিনি শোকগ্রস্ত হলেন কেন? উত্তরে বৈশ্য জানালেন যে, তার নাম সমাধি বৈশ্য। তিনি ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী-পুত্রগণ অসাধু। তারা তার ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। আত্মীয়-বন্ধু যারা ছিল, তারা কেউ আর জিজ্ঞাসাও করে না। তাই দুঃখিত হয়ে তার বনে চলে আসা। পরিবার পরিজন কেমন আছে—-এই সব চিন্তা করে তার মন খারাপ। কিন্তু যে পরিবার পরিজনেরা ধন কেড়ে নিয়ে তাঁকে পরিত্যাগ করেছে, তাদের প্রতিও বৈশ্যের কেন স্নেহের উদ্রেক হচ্ছে—এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না বশ্য। তবু তার মন খারাপ হচ্ছে কেন? তার মমতা হচ্ছে কেন? কারণ, তার আত্মীয় স্বজনকে তিনি শত্রু ভাবতে পারছেন না। যারা তাকে দুঃখ দিয়েছে তাদের প্রতিও মন তার আকৃষ্ট হচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে, তা বৈশ্য বুঝেও বুঝতে পারছেন না। ভ্রান্তি, মোহ ও আসক্তির জন্যে এরকম পৃথিবীর সকলেরই হয়ে থাকে।
রাজা সুরথ আর বৈশ্য সমাধি দুজনে ভাবলেন, এই বনেই তো মেধস মুনির তপোবন। দুজনেই যাওয়া যাক মেধস মুনির কাছে। মুনির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন—আমাদের মন খারাপ হচ্ছে কেন? রাজা বললেন,—-রাজ্যহারা হয়ে আমি বনে এসেছি, তবু তাদের কথা মনে করে আমার অশান্তি হচ্ছে কেন? আমি রাজ্যহারা হয়েছি, তবু সেই রাজ্যে ‘আমার রাজ্য’ আমার শরীরের মত বলে বোধ হচ্ছে কেন? এই বৈশ্যকেও আত্মীয় স্বজনেরা তাড়িয়ে দিয়েছে, ধন কেড়ে নিয়েছে। তবুও তিনি তাদের ভুলতে পারছেন না কেন? তাদের প্রতি করুণার ভাব আসছে কেন? আমাদের এই মোহ হচ্ছে কেন?
তখন মেধস মুনি বললেনÑ এর কারণ হচ্ছেন মহামায়া। প্রাণিগণ চোখ দিয়ে দৃশ্য দেখে, কান দিয়ে শব্দ শোনে, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়, জিভ দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে, আর চামড়া দিয়ে গরম-ঠা-া ইত্যাদি স্পর্শ বুঝতে পারে। কাক তো রাত্রে দেখে না, দিনে দেখে। কিন্তু পেঁচা আবার দিনে দেখে না, রাত্রে দেখে। কেঁচো রাতেও দেখে না, দিনেও দেখে না। বিড়াল আবার রাতেও দেখে, দিনেও দেখে। মানুষেরই যে কেবল রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শ সম্পর্কে জ্ঞান আছে তাই নয়, পশু, পাখি, হরিণ, মাছ ইত্যাদি সকল প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। খাওয়ার ব্যাপারে, ঘুমানোর ব্যাপারে পশু আর মানুষ প্রায় একই রকম। আর একটি দেখার জিনিস এই যে, পাখিরা জানে যে বাচ্চারা খেলে নিজের পেট ভরবে না, তবুও নিজেরা না খেয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবার মুখে করে নিয়ে আসে। বাচ্চাদের কত স্নেহ দিয়ে রক্ষা করে। মানুষও উপকার পাবার আশায়Ñ ছেলে বড় হয়ে আমাদের দেখবে, এই মনে করেই সন্তানের প্রতি আসক্ত হয়। তবুও মানুষ মহামায়ার প্রভাবে ভ্রমে পড়ে, আর ‘আমার আমার’ করে কষ্ট পায়। এই মোহ এবং মমতাই সংসারের জাল। এই মহামায়া জগৎপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা। এই শক্তিই জগতের সকলকে মোহে আচ্ছন্ন করে রেখে আসল ব্যাপারটা দেখতে দেয় না। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, জগৎ মানেই এই মোহের খেলা। বুদ্ধিমানদিগের মনও এই মহামায়া মোহযুক্ত করে ফেলেন। এই সমস্ত প্রাণী, বস্তু সবই তিনিই সৃষ্টি করেন। তিনি খুশি হলে মানুষকে এই মোহ ও মমতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারেন। যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে সকলেই মুক্ত হতে পারে, সেই ব্রহ্মজ্ঞান তিনিই। আবার সংসারের বন্ধনের কারণ যে অবিদ্যা বা অজ্ঞান তাও তিনি।
রাজা সুরথ জিজ্ঞেস করলেনÑ যাকে আপনি ‘মহামায়া’ বলছেন তিনি কে? তিনি কিরূপে, কোথা থেকে উৎপন্ন হন? মেধা ঋষি বললেনÑ এই মহামায়ার উৎপত্তি নেই এবং বিনাশও নেই। এই যে জগতের যা কিছু সবই তার বিরাট শরীর। দেবগণের কার্য সিদ্ধির জন্য তিনি আবির্ভূতা হন। সুতরাং মানুষ যে শোকÑ মোহ নিয়ে সংসারে কষ্ট পাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য এই মহামায়ারই শরণ নিতে হবে। শক্তিকে ধরেই শক্তিমানকে জানতে হয়। আগুন আর তার পুড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা যেমন অভিন্ন, সে রকম ঈশ্বর আর তাঁর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের শক্তি অভিন্ন। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের শক্তি না থাকলে তাঁকে ঈশ্বরই বলা যাবে না। দুর্গাপূজা তাই ভগবানের সৃষ্ট দেবতার আরাধনা নয়, মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গাপূজা তাই মাহাত্ম্যপূর্ণ। দেবতা আর অসুরের সংগ্রাম। মহাকাব্যে মহাকবিÑ কাব্যের আকারে এই দ্বন্দ্ব বর্ণনা করেছেন। দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে দেবতারা শেষপর্যন্ত জয়ী হনÑ কারণ তারা ভগবানের শরণাপন্ন হয়েছেন। অসুরেরা অসূতে রতÑ মানে ইন্দ্রিয়পরায়ণ। দেবতারা ভোগের দেশের অধিবাসী। সেই দেবতারাও স্বর্গভ্রষ্ট স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে মহিষাসুর স্বর্গের রাজা হয়ে বসেছে। দেবতাদের অধিকার হরণ করেছে। এই দুর্গাপূজা করে, দুর্গাদেবীকে সন্তুষ্ট করে, দেবতারা মহিষাসুরের দখল থেকে স্বর্গরাজ্য এবং তাদের অধিকার পুনরায় ফিরে পেলেন। রামচন্দ্রের রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা হয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধে জয়ের জন্যে অর্জুনকে দুর্গাস্তব করতে বলেছেন। এই পূজা করেই সুরথ রাজা তার রাজ্য ফিরে পেলেন। আবার সমাধি বৈশ্য সমস্ত মোহ ও মমতার সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম আনন্দ অনুভব করলেন, আর তার সংসারের দুঃখে জন্মগ্রহণ করতে হবে না, তিনি মুক্তিলাভ করলেন। প্রাচীনকালে যেমন সত্য ছিল, বর্তমান কালেও তাই। বর্তমানেও মানুষ ধন-পুত্র, যশ, রূপ, জয় ইত্যাদি লাভের জন্য দুর্গাপূজা করে থাকে। ভক্তি ও মুক্তিলাভের জন্যও মহামায়ার পূজা করে ধন্য হয়।
আমরাও দুর্গা দেবীকে প্রণাম জানাই—
যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
—- যে দেবী সকল প্রাণীতে শান্তিরূপে বিরাজিতা, তাকে কায়-মন-বাক্যে প্রণাম জানাই।
আমরা তার শরণাগত : সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে। ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবি নমোহস্তু তে ॥
—-হে দেবি, আপনি সর্বরূপিণী, সর্বেশ্বরী, সর্বশক্তিময়ী। আপনি আমাদের সকল আপদ থেকে রক্ষা করুন। হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণা।
অধ্যক্ষ, শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম, চাঁদপুর।