মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের পক্ষে আমরা
মিল্টন বিশ্বাস
১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) আমার সুযোগ হয়েছিল কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এবং টেকনাফ হয়ে শাহ পরী দ্বীপ ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখার। তার আগেই রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার ছবি, ভিডিও, শিশু-মহিলা-বৃদ্ধদের কান্না, চিৎকার, আহাজারি প্রভৃতি এদেশের সকলে দেখেছেন, জেনেছেন। সেই দেখায় পালিয়ে আসা মানুষগুলোর চোখের চাহনির যে আকুলতা তা আমাদের কাতর করেছে। তবে গত কয়েক দশকে তাদের সংখ্যা এদেশে পাঁচ লাখের কাছে পৌঁছেছিল। সেই সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে আট লাখ। আর শেখ হাসিনা সরকার সীমিত সাধ্য নিয়ে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বাঁচানোর এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর। মানুষ হিসেবে আমরা অবশ্যই এই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলব। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আমি দেখলাম মানবিক সংকটের কাহিনিগুলো বিশ্বজুড়ে একই রকমের। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সেদিনও দেখা যাচ্ছিল ধূ¤্র উদগীরণ হতে। বিশালাকার কিংবা কু-লী পাকানো আগুনের ধোঁয়ায় নীলাকাশ ঢেকে যাচ্ছিল। শান্ত নাফ নদী দিয়ে তখনও বার্মিজ গরু নিয়ে পার হচ্ছে অসহায় কৃষক। শাহ পরী দ্বীপে বসে আছে সর্বস্বহারা মানুষ, যার অধিকাংশ শিশু ও নারী। যারা নৌকায় পার হয়ে টেকনাফে এসে পৌঁছাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে বসে থাকতে দেখেছি তাদের। কারণ নৌকার ভাড়া তখন জনপ্রতি একশ টাকা। কপর্দকহীন অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য এদেশে যেমন দরদী লোকের অভাব নেই, তেমনি ঠক-প্রতারকেরও আনাগোনা কম নয়। দরিদ্র ও পরিস্থিতির শিকার মানুষকে জিম্মি করে নিজের আখের গোছানোর মানুষও দেখা গেছে। ক্যাম্পে নতুন আসা মানুষদের মধ্যে হাসি নেই, তবু কথা বলতে চায় তারা। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এদেশে আশ্রয় পেয়ে জীবনটা বেঁচেছে তাদের, এখানেই মরতে চায় তারা। কেউ কেউ পুরানো ক্যাম্পের আত্মীয় স্বজনের কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। ১৪ তারিখ টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার ফিরে আসার সময় দেখলাম সমুদ্র তীরবর্তী সড়কের কিছু দূরে দূরে নতুন আসা শরণার্থী সাহায্যের আশায় রোদের মধ্যে বসে আছে। উখিয়া যাবার পথে গিয়েছিলাম মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতালে। সেখানে মিয়ানমার সেনাদের দ্বারা আহত শিশুদের চিকিৎসা নিতে দেখে এসেছি। নির্বিচারে গুলি ছুঁড়েছে সেনারা। ছোট শিশুরা আহত হয়েছে, বয়স্করা দুমড়ে মুচড়ে গেছে।
২. ১২ সেপ্টেম্বর (২০১৭) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেছিলেন, এদেশের ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ও খাওয়ানো কোনো কঠিন কাজ নয়। আর সেই ক্যাম্পের আশ্রয় ব্যবস্থাপনা দেখতে এদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা সেখানে গিয়েছিলেন ১৩ তারিখে। সেদিন থেকে ওইসব এলাকায় মানুষের ঢল নামে, ত্রাণের পর ত্রাণ নিয়ে ছুটে যায় বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টি তার দলীয় নেতাকর্মীকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহ যুগিয়েছে। উপরন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকরা ( যেমন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন আর রাখাইন রাজ্যে ফেরত যেতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের নীতি হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো।
এজন্য ২১ সেপ্টেম্বর (২০১৭) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে নিজ ভূখ- থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ৮ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন, এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।’ একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছি। এ বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে।’ অর্থাৎ সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শরণার্থীদের এখনই নিরাপদে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর পক্ষে। তিনি মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণের যেমন সমালোচনা করেছেন, তেমনি রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কর্মকা-কে প্রশ্রয় কিংবা সমর্থন করেননি। এজন্য ওই ভাষণের শেষে পুনরায় বলেছেন, ‘আমরা ধর্মের নামে যেকোনো সহিংস জঙ্গিবাদের নিন্দা জানাই। সহিংস জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে আমরা পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করেছি।’ উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে শুরু হয় সেনা অভিযান, এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল।
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা। বর্তমানে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। সামরিক সরকার (১৯৬২ থেকে) তাদের অনেক মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ২০১২ সালে ট্রেনে রোহিঙ্গা মুসলমান কর্তৃক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুণী ধর্ষণের জের ধরে সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দ্বারা পরিচালিত বর্বরতায় প্রায় এক লাখ বিশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম দেশত্যাগ করে। সে দেশ ছাড়াও বিভিন্ন সময় সামরিক জান্তার নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে মালেশিয়ায় প্রায় ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৫ লাখ এবং প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা সৌদিআরবে পালায়। বর্তমানে সেখানে সামরিক অভিযান চলছে ‘মুসলমান রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা’ হিসেবে। ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামের কমপক্ষে ৮৩০টি বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। একথা সত্য এসব অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে সেখানে জন্ম নিয়েছে রোহিঙ্গা বিপ্লবী গোষ্ঠী। কিন্তু সেই বিপ্লবী গোষ্ঠীকে আমরা সমর্থন করি না। কারণ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী আমরা। শেখ হাসিনার বিভিন্ন বক্তব্যে দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে সেই সত্যই প্রকাশ পেয়েছে।
৩. শেখ হাসিনা জাতিসংঘে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে অন্যতম দু’টি প্রস্তাব হলো- ক. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। খ. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। অবশ্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সমালোচনার প্রেক্ষাপটে শরণার্থীদের যাচাই সাপেক্ষে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অং সান সু চি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা ‘আসিয়ান’ কর্তৃক চিহ্নিত হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ জাতিগত সহিংসতা’ রূপে। আসলে শেখ হাসিনার মতামত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কথা থেকে আমরা মনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সবচেয়ে ভাল পথ। ফেরত পাঠানো না হলে সমস্যার বোঝা এদেশের জনগণকে বহন করতে হবে ভবিষ্যতে। অন্যদিকে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফেসবুক, ব্লগ ও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে ছবি পোস্ট দিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে একটি মহল। পরিকল্পিতভাবে কিছু ভুয়া ছবি এবং তথ্য দিয়ে এদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে। আমাদের অভিমত, এ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে সরকারের উচিত এ ধরনের অপপ্রচার নিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য সরকারেরও উচিত এই মাধ্যম ব্যবহার করা। এর আগে একই ধরনের অপপ্রচার হয়েছে। তবে এ ধরনের অপপ্রচার রোধ করা না গেলে যে কোনো সময় বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবেই করছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নির্যাতনের ভুয়া ছবি ও তথ্য ছড়িয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে তারা। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেমন সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে তেমনি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে মিয়ানমারের প্রকৃত ঘটনার তথ্যচিত্রের দিকে। কারণ আমরা তাদের ভৌগোলিক অখ-তায় বিশ্বাস করি।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ৎিরঃবৎসরষঃড়হনরংধিং@মসধরষ.পড়স)
সম্পাদনা: আশিক রহমান