মানবিক এবং দানবিক আমরা!
বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ আজ এক নতুন রূপে পরিচয় পেয়েছে। কিছুদিন আগেও বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পরিচয় মিলত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। মানব পাচারের দেশ হিসেবেও পরিচয় মিলল বাংলাদেশের যখন কিনা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া হাজারো হতভাগা মানুষের গণকবরের সন্ধান মিলল। উগ্রবাদীদের দ্বারা একের পর এক ব্লগার লেখক প্রকাশক হত্যা সেই সঙ্গে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভিন্ন মতার্দশ ও ভিনদেশি নাগরিকদের হত্যায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ পরিচয় মিলতে থাকে ইসলামিক উগ্রবাদীদের নিরাপদ ভূমি হিসেবে। সব কিছু ছাপিয়ে এবার বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পরিচয় মিলেছে মানবিকতার দেশ হিসেবে। মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী সেই সঙ্গে সে দেশের বৌদ্ধ উগ্রমৌলবাদীদের জাতিগত নিধনের কৌশল হিসেবে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষ। প্রায় দশ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্বমিডিয়া ও রাজনীতি। এত মানবিকতা, এত সহনশীলতার মাঝেও আমাদের দেশের ভেতর মানুষরূপী কিছু দানবের আবির্ভাব হয়। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যে যেদিক দিয়ে যেভাবেই পারছে বাংলাদেশের আসছে। তাদের একটি অংশ সমুদ্র পথে নৌকায় পারিজমাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নৌকাডুবির ঘটনায় জীবন দিতে হয়েছে প্রায় শ’খানেক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ আর শিশুকে। বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব নৌকাডুবির ভয়ঙ্কর কাহিনী। প্রায় সব কটি নৌকডুবির ঘটনাই ইচ্ছাকৃত। রোহিঙ্গাদের নাফ নদী পারাপারের বাণিজ্যে লিপ্ত টেকনাফের স্থানীয় কিছু দালাল চক্র। এই চক্রে নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত জড়িত। এই দালাল চক্র নদী পারাপারের নাম করে অসহায় রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। রোহিঙ্গারা দালালদের চাহিদা মতো টাকা দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটছে নৌকাডুবির ঘটনা। এতে জীবন দিতে হচ্ছে অনেক শিশু ও নারীদের। এছাড়াও একশ্রেণীর স্থানীয় দালাল সরকারি জমি কিংবা পাহাড়ে বোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে ঘর তুলে দেওয়ার কথা বলে আদায় করছে টাকা এমনকি কোনো কোনো দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যেতে ও বিদেশ পাঠানোর নাম করে আদায় করে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। আর গুটি কয়েক দালালের এহেন কর্মকা- ম্লান করতে বসেছে আমাদের সরকার ও সাধারণ মানুষের সমস্ত অর্জন। এতো গেল রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের দেশের কিছু দানবের কথা। সম্প্রতি এমনই নৃশংস খুনের তালিকায় যোগ হয়েছে ময়মনসিংহে সাগর ও বগুড়ার রাসেলের নাম। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় চোর সন্দেহে সাগর নামের ষোল বছর বয়সী দরিদ্র ফেরিওয়ালা বাবার সন্তান সাগরকে পানি তোলার কাজের মোটর চুরির অভিযোগ এনে আক্কাস নামের এক হ্যাচারি মালিক ও তার সহযোগীরা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্যাতনকারীরা সাগরকে হত্যার পর তার লাশ একটি কাশবনের মধ্যে রেখে পালিয়ে যায়। বগুড়ায় কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে রাসেল মিয়া নামে ঊনিশ বছরের এক যুবককে হত্যা করেছে তারই সহকর্মী। বগুড়ার কাহালু উপজেলার বীরকেদার এলাকায় এবিসি টাইলস নামে একটি সিরামিক কারখানার শ্রমিক রুবেল হোসেন নামের সহকর্মী রাসেল মিয়ার পায়ুপথে জোরপূর্বক বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাসেল অসুস্থ হয়ে পড়লে কারখানার লোকজন তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে রাসেল। যদিও পুলিশ সাগর ও রাসেলের খুনিদের খুব তাড়াতাড়িই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
রাজন ও রাকিব হত্যাকা-ের ঘটনায় দেশ বিদেশে থাকা সকল বাংলাদেশির ভেতরেই যন্ত্রণা দিয়েছিল। এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ায় রাজনের মূল হত্যাকারীকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে বাধ্য হয় সরকার। রাজন হত্যা মামলায় প্রধান আসামিসহ চার জনকে মৃত্যুদ- ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। পরে যদিও উচ্চ আদালত রাকিবের দুই হত্যাকারীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছে কিন্তু রাজন হত্যাকারী চার জনের মৃত্যুদ- আজও কার্যকর হয়নি। অসহায় রোহিঙ্গাদের নৌকাডুবিয়ে হত্যা ছোট্ট শিশুটিকে সামান্য চুরির অপবাদ এনে পিটিয়ে কিংবা কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা এটা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না বা মেনে নেওয়ারও কথা না।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান