
বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের আলোকে দারিদ্র্য বিমোচন
মো. আনিসুজ্জামান : গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতীয় সমাজ চারবর্ণে বিভক্ত ছিল। বর্ণ অনুসারে কর্ম নির্ধারিত হতো। সমাজের নিচু স্তরের শূদ্র কখনো অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হয়নি। বৎসর বৎসর শূদ্র সমাজের নিচে থেকেছে। অভাব অনটন ও চরম দারিদ্র্য সীমা এরা অতিক্রম করতে পারেনি। জন্মসূত্রে এক শ্রেণি আরেক শ্রেণিকে শোষণ, শাসন করেছে। শুদ্র যে শুধু শোষিত তাই নয়, এমনকি প্রাচীন ভারতে শূদ্রের মৃত্যুর পর সৎকার করা হতো না। ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হতো। ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধ প্রথম বর্ণপ্রথা বিমুক্ত করেন। তিনি বলেছেন মানুষের পরিচয় জন্মে নয় কর্মে। কর্মের দ্বারাই মানুষ নিজের পরিচয় নির্ধারণ করে। কর্ম এবং সৃজনশীল ক্ষমতাগুণেই সমাজে মানুষ নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি বর্ণ প্রথা বিলুপ্ত করেছেন।
বর্ণপ্রথার বিলুপ্তি করে গৌতম বুদ্ধ বংশ পরম্পরায় দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। শূদ্র ঘরে জন্মালেই যে দরিদ্র থাকতে হবে এই ধারণার পরিবর্তন করেন গৌতম বুদ্ধ। সমাজে মানুষের অবস্থান নির্ধারিত হয় কর্মের দ্বারা। শূদ্র যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করে সমাজে ভাল অবস্থানে থাকতে পারে। আবার ব্রাহ্মণ কর্মগুণে সমাজে নিন্দিত হতে পারেন। গৌতম বুদ্ধ কর্মগুণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বুদ্ধের সংঘে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সমান মর্যাদা ছিল। শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়সহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল সংঘে। চারবর্ণে বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান ছিল সবার নিচে। কি ব্রাহ্মণ কি শূদ্র কোনো নারীই সম্পদের মালিক ছিল না। গৌতম বুদ্ধ নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুণী সংঘে পুরুষের আধিপত্য ছিল। বুদ্ধের পালিতা মা গৌতুমীর আগ্রহে এবং আনন্দের অনুরোধে আটটি শর্ত পালন সাপেক্ষে গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছিলেন। সংঘের নারীরা সবাই সমান মর্যাদা ভোগ করতেন। ভিক্ষুণী সংঘ ভিক্ষু সংঘের সমকক্ষ ছিল না।
গৌতম বুদ্ধের সময়ও নারীর বস্তুগত কোনো সম্পদই ছিল না। নারী চরম দারিদ্র্য সীমায় বাস করতো। বিত্তবান ঘরের নারীদেরও বস্তুগত কোনো সম্পদ ছিল না। মানসিক অবস্থাও তাদের সঙ্কটাপন্ন ছিল। সংঘে প্রবেশের অধিকার দিয়ে নারীদের বস্তুগত এবং মানসিক দারিদ্র্যাবস্থা থেকে মুক্ত করেন বুদ্ধ।
গৌতম বুদ্ধ স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, সম্পদের সুষম বন্টনের নীতি প্রণয়ন করেন রাজা। সে সময় ভারতবর্ষে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল। গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন, প্রজাদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব রাজার। জনকল্যাণমুখী রাজা সমাজের সকলের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন। দরিদ্র মানুষের মাঝে রাজা শুধু দান করে দারিদ্র্যাবস্থার অবসান করতে পারেন না। পরিমিত দান সমাজকে সুস্থ করে।
বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনে দেখা যায় সাধারণ মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য রাজার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজা প্রজাদের উপকার করবেন। প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধির উপর রাজ্যের স্বাস্থ্য নির্ভর করে।
গৌতম বুদ্ধ দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য শুধু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন নি। একজন সমাজ উন্নয়ন কর্মী হিসাবে তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বুদ্ধের সময় বৈশালীতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ শিষ্যদের নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য বিত্তবান শ্রেষ্ঠীদের ঘরে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। বুদ্ধের আহ্বানে সে সময় শ্রেষ্ঠীরা প্রচুর দান করেছিল। কুশল রাজ্যে দুর্ভিক্ষের সময়ও গৌতম বুদ্ধ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের আহ্বানে বিত্তবান শ্রেষ্ঠীরা প্রথমে এগিয়ে না আসলেও কুশলের ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে অবশ্য বিত্তবান শ্রেষ্ঠীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ শুধু দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য সামান্য দানের ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। মনুষ্যসৃষ্ট কারণে যেন দুর্ভিক্ষ না হয় তার চেষ্টাও করেছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য সম্পদ সঞ্চয় করার কথাও তিনি বলেছেন। গৌতম বুদ্ধের সময় প্রকৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বন্যা, খরা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে য খাদ্যাভাবের সৃষ্টি হয় তার-চেয়ে মানুষই বেশি কৃত্রিম খাদ্য সংঙ্কট সৃষ্টি করে। কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের চরম বিরোধী ছিলেন বুদ্ধ। বীজ সংরক্ষণের কথা গৌতম বুদ্ধ বলেছেন। ভিক্ষুদের ফসলের বীজ দান হিসাবে গ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
অধিক মুনাফা এবং সঠিক বন্টন নীতির অভাবে খাদ্যাভাব এবং নানা ধরনের অবিচার-অন্যায়ের সৃষ্টি হয়। ফলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন, এসবের শুরু মন থেকে।
মানুষের সবকিছু শুরু হয় মন থেকে। মন থেকে পরিকল্পনা শরীরে রূপ নেয়। তাই সকল কর্মের আগে মনের বিশুদ্ধতা প্রয়োজন। এই জন্য গৌতম বুদ্ধ দুঃখময় মানবজাতির মুক্তির জন্য আটটি মার্গ এবং পাঁচটি শীল নির্ধারণ করেছেন। সম্যক দৃষ্টি বা যথার্থ জ্ঞান, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বচন, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি এই আটটি মার্গ এবং পাঁচটি শীল পালন করলে মানবজীবন ভবচক্র থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক, প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
