
বুদ্ধর ‘চতুরার্যসত্য’
বুদ্ধ চারটি সত্যজ্ঞান লাভ করেন। এই চারটি সত্যজ্ঞানকে বলা হয় ‘চতুরার্যসত্য’ ।
প্রথম আর্য সত্য ঃ প্রথম আর্য সত্য হলো জীবন দুঃখময়। বেঁচে থাকতে হলে সারাজীবন দুঃখ ভোগ করে যেতে হয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে হল দুঃখ ভোগ না করে উপায় নেই; কোনো না কোনোরকম দুঃখ ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে অসুস্থতা, শারীরিক আঘাত, ক্লান্তি, বার্ধক্য যন্ত্রণা, একাকীত্ব, হতাশা, ভীতি, অস্বস্তি, অসোন্তষ, ক্রোধের মতো মানসিক ক্লেশ এবং অবশেষে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হয়। জীবনজগতে প্রিয়বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ এড়ানো সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় আর্যসত্যঃ দ্বিতীয় আর্যসত্য হলো, ‘অনিময়মতান্ত্রিক লাগামহীন চাহিদা দুঃখের সৃষ্টি করে’। আমাদের মানসিক যন্ত্রনার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না কীভাবে দুঃখের সৃষ্টি হয়। যখন আমরা কিছু পেতে চাই, পাই না, তখন হতাশাগ্রস্থ হই। কোনো প্রিয়ব্যক্তিকে আমাদের আশানুরূপ বয়সপর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে চাই, কিন্তু, পারি না, তখন আবার উৎকণ্ঠায় ভেঙ্গে পড়ি। আমরা চাই অন্যরা আমাদের সম্মান করুক, পছন্দ করুক, যখন তা হয় না তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তা ছাড়া, যা চাই তা পেলেও সম্পূর্ণ সুখী হওয়া যায় না। কারণ কিছুদিন পর প্রাপ্ত বস্তুর প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়। এর পর অন্য কিছু পেতে ইচ্ছা জাগে। দ্বিতীয় সত্যের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে, নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামহীন চাহিদা আমাদের প্রকৃত সুখশান্তি দিতে পারে না। অবিরাম আরো চাই এর চাহিদা মেটে না। প্রয়োজন মেটানোর সন্তুষ্টি সীমাবদ্ধ রাখার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি নিহিত।
তৃতীয় আর্যসত্য ঃ তৃতীয় আর্যসত্য হলো দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করা যায়। চতুরার্য সত্যে এটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখানে বুদ্ধ আমাদের সুখশান্তি পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা যখন অর্থহীন লাগামহীন চাহিদা বর্জন করি, সংসারের অপরিহার্য বাস্তবতাকে দৈর্য ও অধ্যাবসায়ে ও ক্রোধহীন হয়ে সমাধান করে অন্যের প্রতি ঘৃণাবোধ রোধ করি, বর্তমানের প্রতিদিনটিতে অভিজ্ঞতালদ্ব আনন্দে বাঁচার সন্তুুষ্টি নিয়ে বাঁচতে শিখি, এইভাবে মৃত অতীতের জন্য অনুশোচনা না করে, বরং অতীতের কৃত ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করে, অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে দুঃশ্চিন্তা না করে, সম্পূর্ণভাবে বর্তমানের প্রতি মুহূর্তের মধ্যে বাঁচার অনুশীলন করে বর্তমানকে কুশল করে, ভবিষ্যৎতকে মনোরম করে গড়া যায়। আমরা এভাবে দুঃকে অতিক্রম করে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করতে পারি। এই অবস্থায় আমরা নিজের গন্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা মুক্ত হয়ে অন্যকে সাহায্য করার সহমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। এ অবস্থার ক্রম-অগ্রগতির ফলে মানসিক সকল প্রকার যন্ত্রণার উপশম হয় এবং নির্বাণের পথ সুগম হয়।
চতুরার্য সত্য ঃ চতুর্থ সত্যে দুঃখ দূর করার উপায় উল্লেখ আছে। এই উপায়কে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। এই আট অঙ্গ হলো ঃ
১. সম্যকভাবে বুঝা বা হৃদয়াঙ্গম করা। সম্যাকদৃষ্টিতে যা যেমন তাকে তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করা।
২. সম্যক কর্ম হলো, সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদন করার সংকল্প গ্রহণ করা।
৩. সম্যক বাক্য হলো, নিজের ও অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন বাক্যালাপ।
৪. নিজের ও অন্যের জন্য কুশলধর্মী কর্ম সম্পাদন করা।
৫. সম্যকভাবে জীবিকা অর্জন করা (মাদক দ্রব, বিষ, মাছ-মাংস, মারাণাস্ত্র, দেহব্যবসা ইত্যাদি অসম্যক জীবিকা। )
৬. সম্যক চেষ্টা করা।
৭. সম্যক স্মৃতি হলো যখন যা করা হয় তখন তাতে সচেতন মনোযোগ রাখা।
৮. সম্যক সমাধি হলো জীবনাচরণে মনের একাগ্রতা।
( কুশলপ্রশ্নোত্তর, মূল লেখক ঃ ভদন্ত এস. ধাম্মিকা
অনু ঃ অধ্যাপক ডাঃ অরবিন্দু বড়–য়া)
