কামরুল আহসান : বুদ্ধ কাউকে শাস্তি দিতেন না। যতোবড় অপরাধীই হোক, তিনি ক্ষমা করে দিতেন। মানুষকে তিনি নিজের কাছে ফিরাতেন। বুদ্ধের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিজের কাছে ফেরা। নিজের অর্জিনাল অস্তিত্বের কাছে ফেরা। মানুষের প্রকৃত সত্তা কী? মানুষের প্রকৃত সত্তা হচ্ছে এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মা-ের সঙ্গে একাত্ব হওয়া। অঙ্গলিমাল নামে এক বিখ্যাত ডাকাত ছিল। মানুষের আঙুল কেটে কেটে অঙ্গলিমাল মালা বানিয়ে নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। এই জন্য তার নাম অঙ্গলিমাল। আসল নাম অহিংসক। এক রাজার ছেলে। গুরুপতিœর সঙ্গে প্রণয়ের অভিযোগে তাকে আশ্রম থেকে বিতাড়িত করা হয়। আর গুরু তাকে বলে দেন, যদি তুমি আবার আমার কাছে আবার জ্ঞান অর্জন করতে আসতে চাও তাহলে তোমাকে এক হাজার একটা মানুষের আঙুল কেটে নিয়ে আসতে হবে। জ্ঞান-অর্জনই অহিংসকের জীবনের ব্রত। সুতরাং সে গুরুর আদেশ শীরধার্য করে মানুষের আঙুল কাটতে থাকে। এই নিয়ে শাহযাদ ফিরদাউস রচনা করেছেন অসমান্য এক উপন্যাস অঙ্গলিমাল। বুদ্ধর সহচার্যে অঙ্গলিমাল আলোকপ্রাপ্ত হয়ে উঠেন। যখন সমগ্র রাজ্য তাকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে আসছে তখন বুদ্ধ গিয়ে সামনে দাঁড়ান। বলেন, হত্যা একজন মানুষ শুধু এই পৃথিবী থেকে বহিঃস্কার করতে পারে। তাকে তো মুক্তি দিতে পারে না। একজন মানুষ যখন মুক্ত হয় তখন সে অন্য একজন মানুষের মুক্তির পাথেয় হয়।
কুশলরাজ্যে একবার ধরা পড়েছিল দুই যক্ষ। তারা জঙ্গলে থাকতো, বন্য। তারা মানুষের বাচ্চা চুরি করে ধরে ধরে খেয়ে ফেলতো। কারণ, সভ্য মানুষ জঙ্গলের সমস্ত পশুপাখি খেয়ে ফেলেছিল। জঙ্গলে যারা থাকে তাদের আর খাবার ছিল না। তারা কী করবে? তাই তারা মানুষের বাচ্চাই ধরে ধরে খাওয়া শুরু করল। একদিন ধরা পড়ল দুই যক্ষ। বুদ্ধ নিজেই ধরলেন। যক্ষের দুই সন্তানকে ধরে জেতবনে নিয়ে আসলেন। তখন যক্ষ দুজন নিজেরাই এসে ধরা দিল। নিজেদের বাচ্চার জন্য তাদের তখন অমানুষিক কান্না। যক্ষনারী বুদ্ধকে ধরে খাঁমচাতে চাচ্ছিল। বুদ্ধ তখন বললেন, তোমরা নিজেদের সন্তানের জন্য কাঁদছো, কিন্তু, তোমরা অন্য মানুষের সন্তনদের আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছো। তোমাদের এখন যেমন কষ্ট লাগছে অন্য মানুষদেরও তেমন কষ্ট লেগেছে। যক্ষনারীপুরুষ স্তব্দ হয়ে যায়। অন্য মানুষদেরও যে তাদের মতো ব্যথা আছে তা তারা জানতোই না। রাজ্যের মানুষ যক্ষ নারীপুরুষকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু বুদ্ধ বলেন, ওরা তো জানতো না সত্য কী? মৃত্যদ- দিয়ে কী হবে? ওদের ক্ষমা করে দাও।
নারীপুরুষ দুজন জেতবনেই থাকে আর রাতদিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে পশুর মতো কাঁদে, হায়, কী অপরাধ তারা করেছে, তারা মানুষ খেয়েছে একদিন! কপাল ঠুকতে ঠুকতে তারা নিজেদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। এই গল্প আছে বানী বসুর মৈত্রীয় জাতক উপন্যাসে।