
এক নজরে গৌতম বৌদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম
গৌতম বৌদ্ধ ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক ধর্মগুরু এবং তাঁর দ্বারা প্রচারিত ধর্ম বিশ্বাস ও জীবন দর্শনকে বৌদ্ধ ধর্ম বলা হয়। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে গৌতম বৌদ্ধের জন্ম। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা তাঁর জীবন কথা ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর শিক্ষাগুলো প্রথম দিকে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চারশো বছর পর এগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়। গৌতম বৌদ্ধের পিতা ছিলেন রাজা শুদ্ধোদন আর মাতা ছিলেন মায়াদেবী। মায়াদেবী কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবার পথে অধুনা নেপালের অন্তর্গত লুম্বিনি গ্রামে বৌদ্ধের জন্ম দেন। তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে মায়াদেবীর জীবনাবসান হয়। পরে তিনি বিমাতা গৌতমী কর্তৃক লালিত হন। জন্মের পঞ্চম দিনে রাজা ৮ জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ ও ভবিষ্যৎ বলার জন্য ডাকেন। তাঁর নাম দেওয়া হয় সিদ্ধার্থ যে সিদ্ধিলাভ করেছে বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বলেন,
রাজকুমার একদিন সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে যাবেন এবং বোধিপ্রাপ্ত হবেন। বৌদ্ধের বিবাহ সম্বন্ধে দুই ধরণের মত আছে। প্রথম মত অনুসারে ১৬ বছর বয়সে তিনি একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর স্ত্রীকে লাভ করেন। আর একটি মত অনুসারে ২৮ বছর বয়সে তাকে সংসারের প্রতি মনোযোগী করার জন্য তাঁর পিতা-মাতা তাকে রাজকন্যা যশোধরার সঙ্গে বিবাহ দেন।
কথিত আছে, একদিন রাজকুমার সিদ্ধার্থ বেড়াতে বের হলে ৪ জন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। প্রথমে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, অতঃপর একজন অসুস্থ মানুষ, এবং শেষে একজন মৃত মানুষকে দেখতে পান। তিনি তাঁর সহিস চন্নকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে চন্ন তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, এটিই সকল মানুষের নিয়তি। একই দিন কিংবা অন্য একদিন তিনি দেখা পেলেন একজন সাধুর, যিনি মুক্তিমন্ত্রক এবং পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত। চন্নকে এর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন উনি একজন সন্ন্যাসী যিনি নিজ জীবন ত্যাগ করেছেন মানুষের দুঃখের জন্য। রাজকুমার সিদ্ধার্থ সেই রাত্রেই ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, ও পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। সিদ্ধার্থের এই যাত্রাকেই বলা হয় মহানিষ্ক্রমণ। তার মানে মানুষের বৃদ্ধ হওয়া, অসুস্থ হওয়া, মৃত্যু হওয়া, ও সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে বৌদ্ধের কোনো ধারণা ছিল না। তিনি এগুলো জানতে পেরেছেন চন্ন নামের এক ব্যক্তি থেকে। এই অবস্থায় তিনি ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, ও পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। দুঃখ ও দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ যাত্রা অব্যাহত রাখেন। প্রথমে তিনি আলারা নামক একজন সন্ন্যাসীর কাছে যান। তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি যান উদ্দক নামক আর একজনের কাছে। কিন্তু এখানেও কোনো ফল না পেয়ে কিছু দিন যাবার পর তিনি মগধের উরুবিল্ব নামক স্থানে গমন করেন। সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখি শিলাখরে উপর বোধিসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে, ‘যদি আমাকে বৌদ্ধত্বলাভ করতে হয় তা হলে বৌদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক।’ এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিলাখরে গায়ে তিন ফিট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হয়। বোধিসত্ত্ব তপস্যায় বসার পূর্বে দৈববাণী হয় যে, ‘বৌদ্ধত্ব লাভ করতে গেলে এখানে বসলে চলবে না; এখান থেকে অর্ধযোজন দূরে পত্রবৃক্ষতলে তপস্যায় বসতে হবে।’ এরপর দেবগণ বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে করে এগিয়ে নিয়ে যান। মধ্যপথে একজন দেবতা ভূমি থেকে একগাছা কুশ ছিড়ে নিয়ে বোধিসত্ত্বকে দিয়ে বলেন যে, এই কুশই সফলতার নিদর্শন স্বরূপ। বোধিসত্ত্ব কুশ গ্রহণের পর প্রায় পাঁচ শত হাত অগ্রসর হন এবং পত্রবৃক্ষতলে ভূমিতে কুশ গাছটি রেখে পূর্বমুখি হয়ে তপস্যায় বসলেন। কঠোর সাধনার ফলে তাঁর শরীর ক্ষয়ে যায়। কিন্তু এ তপস্যায় তিনি ভয়, লোভ, ও লালসাকে অতিক্রম করে নিজের মনের উপর স¤পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে সক্ষম হলেন। সহসা তিনি বুঝতে পারেন এভাবে বোধিলাভ হবে না। তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশেষে কঠোর তপস্যার পর তিনি বৌদ্ধত্ব প্রাপ্ত হলেন। তিনি দুঃখ, দুঃখের কারণ, প্রতিকার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। এ ঘটনাটিই বোধিলাভ নামে পরিচিত। আক্ষরিক অর্থে ‘বৌদ্ধ’ বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত মানুষকে বুঝায়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাতিক উপলব্ধি এবং পরম জ্ঞানকে ‘বোধি’ বলা হয়।
বৌদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া, বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান, ইত্যাদি। এ সম্বন্ধে বৌদ্ধের চারটি উপদেশ যা চতুরার্য সত্য নামে পরিচিত বলা হচ্ছে দুঃখ একটি বাস্তবতা যা বৌদ্ধের আগেও সকলেরই জানার কথা। এই দুঃখের কারণ হচ্ছে কামনা-বাসনা-বন্ধন। সকল প্রকার কামনা-বাসনা-বন্ধন থেকে মুক্তি লাভই হচ্ছে নির্বাণ। -সদালাপ থেকে নেওয়া
