শরণার্থীদের প্রতি ভালোবাসা যেন বিষাদ না হয়
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ দেখিয়েছে, তা তিনি তার কর্মজীবনে কখনো দেখেননি। তার ভাষায়Ñ ‘বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে শরণার্থীদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, সেখানে বাংলাদেশ সরকার ও মানুষ যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ দেখিয়েছে, তা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।’ একথা সত্য সারাদেশের মানুষের মাঝে মানবতার অন্যরকম এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে হৃদয়জুড়ে। যে যেভাবে পারছেন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন কক্সবাজারে, সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী-প্রয়োজনীয় ওষুধ-নগদ অর্থ দু-হাত ভরে দিয়ে আসছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে। মানুষের জন্য কিছু একটা করার আত্মতৃপ্তির ছবি ফুঁটে উঠছে ত্রাণদাতাদের চোখে-মুখে, অনেকের চোখে দেখেছি ভালোবাসার জলচ্ছবি। রাত দিন অভাবনীয় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সেচ্ছাসেবী, সেনাবাহিনী-বিজিবি-পুলিশসহ সরকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। তাদের সঙ্গে ঘাম ফেলছেন স্থানীয় অনেক মানুষ। কোথাও মেডিকেল ক্যাম্প, খানিক পরপর ত্রাণ শিবির, অস্থায়ী বসতি নির্মাণের তড়িগড়ি। সব মিলিয়ে মানবসেবার এক মহাযজ্ঞ দেখলাম চোখের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া এলাকাজুড়ে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, এই যে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা তা ধ্রুব সত্য নয়। ফিলিপ্পো গ্রান্ডির ভাষায় তাদেরকে এখন এদেশের মানুষ শত্রু না ভাবলেও ভালোবাসা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এর পেছনের কারও অনেক। গত শনিবার গিয়েছিলাম বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্থায়ী-অস্থায়ী বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে। ‘মৃত্যূর বিভীষিকা’ শব্দ দুটির অর্থ এতদিন জেনে এলেও এই বোধ হয় প্রথম দেখলাম ‘জীবনের বিভীষিকা’ কাকে বলে! মাইলের পর মাইল লাখ লাখ উদ্বাস্তু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন অপরিকল্পিতভাবে। একের পর এক পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে উদ্বাস্তু বসতি। প্রকৃতির ওপর এই চাপ কীভাবে সামাল দেবে মানুষ? প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র গোছের অচেনা যে কাউকে দেখলেই শিশু থেকে বৃদ্ধ পেতে দিচ্ছেন দু-হাত। হাত বাড়িয়ে দেওয়া শত শত শিশুকে দেখে মনে হচ্ছিল এতো মানুষ যদি স্থায়ীভাবে থেকে যায় তবে ভবিষ্যতটা কি তাদের ভিক্ষাবৃত্তি? কথা হয় টেকনাফে উদ্বাস্তু হয়ে আসা ফরমিনার সঙ্গে। তার ছিলো ছয় সন্তান। ছোট তিন সন্তানকে নিজের চোখের সামনে পুকুরে ছুড়ে মেরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে, আর স্বামিসহ অন্য দুজনকে গুলি করে। ফরমিনার বোনের পরিবারেরও আটজনকে হত্যা করেছে সু চি’র সেনারা। একমাত্র জীবিত সন্তানকে নিয়ে ভয়ঙ্কর জীবন বয়ে চললেও খাবার সন্ধানের ব্যস্ততায় তার মাঝে এখন আর কোনো বেগ-আবেগ নেই। মাঝে মধ্যে নিজের অজান্তে কেবল ডুকরে কেঁদে ওঠেন ফরমিনা। দেখা মেলে ১৬ বছরের সাবেকুনের সঙ্গে। পুরোপুরি নির্বাক সাবেকুন, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কেবল। দুর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে হঠাৎ করেই পড়ে গেল মাটিতে। তার মায়ের মুখে জানা গেলোÑ মাত্র কদিন আগে যে ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছিল সাবেকুনের, কোরবানীর ঈদের আগে তাকে হত্যা করে বর্মী সেনারা। সেই খবর শুনে আর নিজ গ্রামে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে ভয়ানক ট্রমায় ভুগছে মেয়েটা। সেই ময়েকে নিয়েই খাবারের সন্ধানে ছুটছেন বৃদ্ধা মা। দেখলাম বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু জঙ্গি আর সেনাদের নির্যাতন শুরুর প্রায় দেড় মাস পরেও বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে দলে দলে ঢুকছে আতঙ্কিত আর নির্যাতিত রোহিঙ্গারা।
কুতুপালংয়ের রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখতে পেলাম অধিকাংশ দম্পতির ৮ থেকে ১২ জন করে ছেলে মেয়ে। ছোট ছোট খুপড়িতে শুধু মাথা গিজগিজ করছে। ভাড়ায় চালিত যে গাড়িতে আমরা কক্সবাজার থেকে নাইক্ষংছড়ি পর্যন্ত যাওয়া আসা করলাম তার কোথাও থামিয়ে তল্লাশি করা হলো না গাড়িটা। বুঝতে পারলাম, নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে এসে রোহিঙ্গারা যাতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ঢুকে যেতে না পারে সেজন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারীর যে খবর কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তে দেখলাম মিয়ানমারের সেনা সদস্যদের উদ্যোগে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। আরও স্পষ্ট হলাম, জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্য তাদের পূর্বপরিকল্পিত। নির্যাতনের ত্রাস সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা এখন সীমান্ত সিলগালা করছে। আর এসব কিছুর কারণেই ভয়ানক চাপা ক্ষোভ কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের মাঝে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের তুলনায় তাদের মাঝে রোহিঙ্গাদের প্রতি আবেগ তেমন নেই বললেই চলে। খুব কাছাকাছি থাকায় বরং তারা চিন্তিত এবং ক্ষুব্ধ বিভিন্ন বিষয়ে। ওয়াশিংটনে গত রোববার প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যদি প্রয়োজন হয় দেশের মানুষ এক বেলা খেয়ে আরেক বেলার খাবার শরণার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবে। এটা নিশ্চয় তার আবেগের কথা। সে আবেগও হয়তো বেশিদিন স্থায়ী হবে না বাস্তবতার কাছে। কক্সবাজারের স্থানীয়দের ধারণা, নতুন করে আসা পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আগের মতোই আর ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। তাদের কথাÑ দেশের বৃহত্তম পর্যটন এলাকার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে খুব শিগগির। রোহিঙ্গারা মিশে যাচ্ছেন বাংলাদেশিদের মূল ¯্রােতে। তাদেরকে আশ্রয় এবং সেবা দিতে গিয়ে প্রায় ৪০টির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছর শেষে হাজার হাজার শির্ক্ষার্থীর পড়াশোনা অনিশ্চয়তার মুখে। খুব স্বাভাবিকভাবে এদেশের প্রতি প্রতিশ্রুতি কম থাকায় শরণার্থীদের দিয়ে যে কোনো অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা সম্ভব এদেশেরই কিছু দুবৃত্তের মাধ্যমে। সঙ্গে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের। সর্বোপরি বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা। তাই আবেগ দিয়ে কথা বলে উদ্বাস্তু মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানও সহজে মিলবে না। আলোচনার নামে মিয়ানমার সরকার তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে কেবল সময়ই ক্ষেপন করছে। রোহিঙ্গাদের সহজে ফিরিয়ে নেবে না। শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে চাপ, সময়ের প্রলেপে তা একটু শীতল করতেই লোক দেখানো যত উদ্যোগ তাদের, ১৯৭৮ থেকে যা এপর্যন্ত করে আসছে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত দেশটি। তাই শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে কেবল বাহাবা’র মধ্যেই আত্মসুখ খুঁজে চললে পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর। বাস্তবতার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবর্তনের জন্য যা যা করা দরকার তার সবটুকু করতে হবে এবং অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে, বাড়াতে হবে কূটনৈতিক দক্ষতা এবং তৎপরতা।
লেখক: সাংবাদিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান