নিয়োগে বিরোধিতা সাম্প্রদায়িক কারণে এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে মায়াকান্না
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে বিএনপি এখন রাজনীতি এবং আদালত পাড়া উত্তপ্ত করার জন্য প্রতিদিন যেভাবে শক্তিক্ষয় করছে তা শেষ পর্যন্ত আবারও মস্তবড় হতাশা দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নিয়ে আসবে তা এখন প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা যাচ্ছে। বিএনপিপন্থি এবং জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের হাতে উচ্চ আদালতের আইনজীবী সমিতি থাকায় তারা সমিতির ব্যানারে যে কর্মসূচি পালন করছে তাতে দলীয় আইনজীবী ছাড়া নির্দলীয় কেউ অংশ নিচ্ছে এমনটি দেখা যাচ্ছে না। তারপরও সমিতি নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও আন্দোলন আদালত পাড়াতেই খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। রাজনীতিতেও খুব একটা জোর পাচ্ছে না। দলের মহাসচিব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব, মওদুদ আহমদসহ আরও যে কজন প্রধান বিচারপতির ইসু্যুটিকে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিচারালয় ধ্বংস করার অভিযোগ এনে প্রতিদিন বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। টকশোতে কজন বিএনপির আলোচক খুব চেষ্টা করছেন একই সুরে কথা বলতে-তাদের কারও অবস্থাই জোরদার হওয়ার কোনো লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং দুর্বল হতে হতে এখন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়া নিয়ে বিএনপি নেতাদের কথা শুনে প্রথম প্রথম কারও কারও হয়তো মনে হয়েছিল যে, ষোড়শ সংশোধনীর রেশ বোধ হয় এখনো শেষ হয়নি। বিএনপির আইনজীবী ও নেতৃবৃন্দ বিষয়টিকে সেভাবে তুলে ধরতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে বেশির ভাগ মানুষ এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সমস্যাটি এখন আর ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্তের ধারে কাছেও নেই, এটি চলে গেছে অন্য এমন কিছু জায়গায় যেখানে সরকার খুব সতর্কতার সঙ্গেই আচরণ করছে, তাদের মর্যাদা এবং সর্বোচ্চ আদালত ও প্রধান বিচারপতি বলেই কথা। বিএনপি বোধ হয় চাচ্ছে সরকারকে উত্তেজিত করাতে এমন কিছু করাতে যার ফলে ঘটনার মোড় ঘুরে বিএনপিকে সুবিধা দেবে। মনে হয় সরকার সতর্ক থেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, কোনোভাবেই পরিস্থিতি ঘোলাটে করার সুযোগ দিচ্ছে না। এখন কম বেশি বুদ্ধিমান সবাই পরিস্থিতি বুঝতে পারছে, কী হচ্ছে, হবে- তা দেখার অপেক্ষায় আছে। বিএনপির নেতৃবৃন্দ যে বিষয়গুলো জানেন না, বোঝেন না-তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে তারা দেশবাসীকে যা শোনাচ্ছেন তা তাদের আসল জানার বিষয় বা ভাবার বিষয় নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনই এখানে মূল লক্ষ্য। সরকারও বিষয়টি মনে হয় না কম জানে বা বোঝে। কিন্তু তারা সামান্যই বিএনপির প্রতিক্রিয়ারও উত্তর দিচ্ছেন।
সরকার যখন এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ প্রদান করে- তখন সরকারের শীর্ষ মহলের ভাবনায় ছিল একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দেশের প্রধান বিচারপতি পদ অলংকৃত করলে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিফলন এক্ষেত্রে ঘটার দাবি করা যেতে পারে। দেশে এবং দেশের বাইরেও সরকারের উদারতার পরিচয়টি অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়- গিয়েছিলও। কিন্তু এখন বিএনপির সকল মহলেই সমালোচনার প্রবণতা লক্ষ্যণীয় ছিল। অনেকে প্রকাশ্যেই সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে এস কে সিনহার নিয়োগটিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতেই দেখা হয়েছিল। সমালোচনা করা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি যখন জনসম্মুখে নানা ইস্যুতে কথা বলছিলেন তখন জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকদের মুখে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে শুনেছি, তাকে আওয়ামী লীগের বিচারপতি বলেও অভিহিত করতে তারা কসুর করতেন না। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের আগে কোনো জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকের মুখে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নামে একটি প্রশংসাসূচক কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। সাম্প্রদায়িক ভাষা প্রয়োগে অনেকেই তাকে চিহ্নিত করতেন। কিন্তু যে দিন রায়টি প্রকাশিত হলো, সেদিনই তাদের সুর একেবারেই উল্টে গেল, এস কে সিনহাকে অতুলনীয় সাহসী এক প্রধান বিচারপতি বলে অভিহিত করা, জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখা থাকার ঘোষণাও অনেকে করতে শুনেছি। একেই বলে দ্বিচারিতা। সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও দল যখন কারও সমালোচনা করে সেটি তাদের বিশ্বাস মতোই করে থাকে, আবার যখন প্রশংসা করে তখন সেটিও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হলেই কেবল করা হয়।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়