জনপ্রতিনিধিদের ‘সাময়িক বরখাস্ত’ গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়
ব্রি. জে. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটা কমিশন হওয়ার কথা ছিল, হয়েছিলও। কথা হচ্ছে, এ আইনের কারণে যদি সরকার জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে তাহলে গণতান্ত্রিক যে প্রদ্ধতি তা বাধাগ্রস্ত হবে। জনগণের ভোটের মূল্য তো রইলো না তাহলে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাথে এসব তো করা যাবে না, উচিত নয়, গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুধু বিরোধী মতের হোক, নিজের দলের ভিন্ন মতের হোকÑ এগুলো করা ঠিক নয়। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সেখানেও এর প্রভাব পড়বে। জনগণ ভালোভাবে নেবে না। এটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বলে আমি মনে করি।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যত শক্তিশালী হয়, দেশের উন্নয়নের ধারাও হয় ততই গতিশীল। আমলাতন্ত্র উন্নয়নের ধারাকে টেনে ধরে। এই যখন অবস্থা, তখন হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনৈতিক মামলায় ছন্দ হারাচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তৃণমূল পর্যায়ে বিরোধী মতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় জড়ানো হচ্ছে। যে লোকগুলো ভোট দিয়েছে তাদের ক্ষুব্ধ করা হচ্ছে। হ্যাঁ, কারও বিরুদ্ধে যদি মামলা থাকে, আইনে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়, অপরাধী হয়, জেলে যায়, তাহলে একটা কথা। এভাবে বরখাস্ত করা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে মিলে না। তাহলে তো সংসদ সদস্যরাও আছে। একই দেশে তো দু’রকম আইন হতে পারে না। জনপ্রতিনিধির যে মর্যাদা বা যে সংজ্ঞা তা তো সবার জন্য প্রযোজ্য।
স্থানীয় সরকার আইনটি সর্বপ্রথম প্রণয়ন করেছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনটি জারি করে। তখন ১২(১) ধারা অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্তের পূর্বে নির্বাচন কমিশনের অভিমত নেয়ার বিধান ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেকগুলো অধ্যাদেশ সংসদে পাস না করলেও এটি সংসদের মাধ্যমে আইনে পরিণত করে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগই বেশি। তবে ফৌজদারি আইনের ধারায় পড়ে এমন অভিযোগ রয়েছে আট শতাধিক। এর ভিত্তিতে সর্বশেষ নির্বাচনের পর ৬ শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে ফৌজদারি আইনের ধারা বলে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে পদ ফিরে পেয়েছেন ৩ শতাধিক জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীনরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত শত শত জনপ্রতিনিধিকে ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর প্রায় ৬ শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে ফৌজদারি আইনের ধারা বলে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে চেয়ারে বসতে পেরেছেন ৩ শতাধিক জনপ্রতিনিধি। তাদের প্রায় সবাই বিএনপি ও মিত্র দলের নেতা-সমর্থক। বিপুলসংখ্যক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করার আইনের ওই ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় সরকার আইনের ১২(১) ধারায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদ স্থগিত হয় এটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এই ধারা কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যা কোনোভাবে যৌক্তিক নয়। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পরিচিতি : সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ : খন্দকার আলমগীর হোসেন
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ