বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা ভিন্ন বিষয়
ড. বদরুল হাসান কচি
স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগ সম্প্রতি বিচার বিভাগে দেশের চলমান বিতর্ক ইস্যুটি নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। আইন-আদালত বিষয়ে দেশের প্রথম এবং জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম সম্পাদনা করতে গিয়ে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে নানান বিশেষজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছি, বিতর্কের জায়গাগুলো পাঠকের কাছে তুলে আনার চেষ্টা করেছি এবং সর্বশেষ ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়, পর্যবেক্ষণ বিতর্ক’ শিরোনামে আমার সম্পাদিত একটি বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর বইটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, এটি নিশ্চয়ই আমার জন্য আনন্দের বিষয়। যেহেতু চলমান বিতর্কিত ইস্যুটি নিয়ে সবাই কমবেশি জানার চেষ্টা করছেন, সেহেতু আইন পড়ুয়াদের কাছে বিষয়টি আরও বেশি আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে বিষয়টি নিয়ে যেহেতু আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাই ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সেমিনারে আমাকে মুখ্য আলোচক হিসেবে আমন্ত্রন জানিয়েছেন।
উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সামনে আমি বলেছি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর দায়বদ্ধতা এক জিনিস নয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দায়বদ্ধতা আছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তারাও সংসদের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেক্ষেত্রে বিচারপতিদের দায়বদ্ধতাও সংসদ তথা জনগণের কাছে থাকা উচিত। অনেকটা একই সুরে অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তুরিন আফরোজ বলেছেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয় এবং তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য একটি বাহ্যিক ফোরাম থাকা উচিত।
‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় : তর্ক-বিতর্ক’ শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারে আমি বলেছিলাম, আমাদের সংবিধান জনগণকেই রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে হিসেবে, ১৬ কোটি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান সংসদই রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ দেয় এবং রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিদের। সুতরাং সংসদের কাছেই বিচার বিভাগ জবাবদিহি করবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই জবাবদিহিতার জায়গায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে একটি অগণতান্ত্রিক পন্থাকে সর্বোত্তম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক এই জায়গায় আমার মনের ভেতর থাকা একটি প্রশ্ন সবার সঙ্গে বিনিময় করতে গিয়ে বলেছি, মার্শাল ল আমলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, আপিল বিভাগ রায়ে তা পুনঃস্থাপন করেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কি করে কার্যকর হয়; যেখানে আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে- সংবিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ- সবটাই হচ্ছে সংসদের ব্যাপার। এমনিভাবে পুরো রায়ে বিতর্কের বহুবিধ বিষয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে নানান অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐ সেমিনারে বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. তুরিন আফরোজ বলেন, রায় নিয়ে বিতর্কের একটি ক্ষেত্র হচ্ছে এখানে মামলার ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বাহিরে ব্যাপক আলোচনা বা পর্যবেক্ষন রয়েছে। যেমন- অবাধ দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকরতা, স্বাস্থ্য পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা, ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মামলার বিষয় বহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে মামলার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ, ন্যাচারাল জাস্টিসের একটা মৌলিক ব্যাপার হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বলা হয়েছে দুদক ব্যর্থ কিন্তু সেখানে দুদকের কোনো প্রতিনিধি কি ছিল? স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা বলার আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়য়ের কোনো প্রতিনিধির বক্তব্য কি নেওয়া হয়েছিল? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যর্থ বলার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধির মতামত কি নেওয়া হয়েছে? ফলে রায়ে বিচারক কী এমন নিক্তি দিয়ে মেপে ফেললেন এসব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ? আমার কাছে এই বিষয়গুলো রায়ের সীমাবদ্ধতা বলে মনে হয়েছে।
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া না দেওয়া প্রসঙ্গে জোর দিতে গিয়ে ড. তুরিন আফরোজ নজীর টেনে বলেন, আপনাদের হয়তো মনে আছে কয়েক বছর আগে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেখানে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয়েছিল। পাশাপাশি ৫ জন খতিব অর্থাৎ ইসলামী স্কলারকে আদালত ফতোয়া নিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করতে বলেছেন। আদালত আইনজীবীদের (অ্যামিকাস কিউরি) মতামতের পাশাপাশি খতিবদের বক্তব্য পর্যালোচনা করেই ফতোয়া অবৈধের রায় ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আজকে যখন প্রশ্ন উঠল সংসদ অপরিপক্ক কিংবা সংসদ বিচারক অপসারণে সক্ষম কি না? ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তর্ক-বিতর্কের প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে এই মামলার আপিল শুনানিতে ১২ জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দশজন অ্যামিকাস কিউরি আদালতে মতামত পেশ করেছিলেন। কিন্তু পার্লামেন্টের কোনো প্রতিনিধি ডাকা হয়নি।
বক্তব্যের একেবারে শেষে সেমিনারে সভাপতির ভাষণে ড. তুরিন আফরোজ গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেন, যদি সংবিধানে বিশ্বাস করি; স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাস করি; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি; তাহলে কিন্তু সংবিধানের যে সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ সুপ্রিমিসি অব কনস্টিটিউশন সেটাই আইনের সবচেয়ে বড় জায়গা। সেখান থেকে বের হয়ে কেউ যদি মনে করেন, তিনি একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন, তিনি কারও কাছে জবাবদিহিতা করবেন না, তাহলে সেপারেশন অব পাওয়ারে চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্সের ব্যাপারটি আর থাকে না।
লেখক : আইনজীবী ও সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম
সম্পাদনা: আশিক রহমান