নিজ সেবার পরিবর্তে জনসেবায় নজর দিন
ইকতেদার আহমেদ
সরকারি কর্মচারিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি। সরকারি কর্মচারীদের বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে- সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মন্ত্রণালয় সংশ্লেষে শীর্ষ পদ হলো সচিবের পদ। বর্তমানে কিছু কিছু সচিবের পদকে সিনিয়র সচিবের পদে উণœীত করা হয়েছে। সচিবদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রির কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের অবস্থান সিনিয়র সচিবের উপরে। বর্তমান অষ্টম বেতন স্কেলে সচিবরা ২০টি গ্রেডের ১নং গ্রেডে সর্বোচ্চ বেতন প্রাপ্ত হন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রির মুখ্যসচিব ও সিনিয়র সচিবদের বেতন স্কেলের গ্রেড বহির্ভূত রেখে ১নং গ্রেডের উপরে বেতন দেয়া হচ্ছে। সচিব ও সিনিয়র সচিবরা একই ধরনের কর্মসম্পাদন করে থাকলেও কোনো নীতিমালা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে একই পদের বিভাজন এই বিষয়ে দেশবাসীর নিকট সরকারের পক্ষ হতে কোনো ধরণের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। পৃথিবীর কোথাও একই পদের এ ধরণের বিভাজন নেই। সরকার কর্তৃক সর্বশেষ যে বেতন স্কেল ঘোষিত হয়েছে, তাতে সরকারের সর্বোচ্চ পদে নিয়োজিত সচিবদের জন্য যে বেতন, ভাতা ও সুবিধাদির সংস্থান করা হয়েছে তা সরকারের আর্থিক সামর্থ এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অপর্যাপ্ত এমনটি দাবি করার কোন অবকাশ নেই।
সচিবগণ চালকসমেত গাড়ি ব্যবহারের জন্য সরকার কর্তৃক প্রাধিকার প্রাপ্ত। সম্প্রতি সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন যে সকল কর্মকর্তাগণ সার্বক্ষণিক চালকসমেত সরকারি গাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রাধিকার প্রাপ্ত সরকারের পক্ষ হতে তাদের সরকার প্রদত্ত গাড়ি ও চালকের পরিবর্তে বিনা সুদে গাড়ি ক্রয়ের জন্য ৩০ লক্ষ টাকা ঋণ এবং গাড়ী চালকের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক ৪৫ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এ সুবিধাটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা ঠিকই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভাগ অথবা প্রকল্প হতে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করে সরকার প্রদত্ত গাড়ির অভাব পূরণ করে চলেছেন। আর তাই যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদবিহীন ঋণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা সার্বিক বিবেচনায় ব্যাহত হতে চলেছে। জনগণ প্রদত্ত কর হতে সচিবসহ সরকারের সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধা সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ করা হয়। দেশের সাধারণ জনমানুষ সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট হতে কোনো ধরণের আর্থিক সংশ্লেষ ছাড়া নিঃস্বার্থ সেবা ও নিরাপত্তা প্রত্যাশী। কিন্তু অধিকাংশ সচিব ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখা গেছে জনগণের সেবা ও নিরাপত্তার চেয়ে নিজ সেবা ও নিরাপত্তার বিষয়ে অধিক নিমগ্ন। অতীতে সচিবদের জন্য বাসগৃহে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে শুনা যায় সরকার সচিবদের জন্য বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর পরিবর্তে উভয়ের জন্য ১৬ হাজার টাকা করে ৩২ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করেছে। সচিবরা ইতোপূর্বে ৩ হাজার টাকা গৃহস্থালি ভাতা প্রাপ্ত হতেন। সচিবরা যখন গাড়িতে করে চলাচল করেন তখন তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল পদমর্যাদার একজন গানম্যান অবস্থান করেন। সচিবরা তার কার্যালয়ে অবস্থানকালীনও গানম্যান তার ব্যক্তিগত সহকারির কক্ষে অপেক্ষমান থাকেন।
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট। সচিবরা তাদের গৃহের জন্য বাবুচি ও নিরাপত্তা প্রহরী জনবলের প্রাধিকার প্রাপ্ত হয়ে থাকলে তা অক্ষুণœ রাখলেই বেকার সমস্যা লাঘবের জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু প্রাধিকার প্রাপ্ত জনবলের পরিবর্তে উভয় জনবলের জন্য সচিবদের যদি ভাতা দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে অধিকাংশ সচিব জনবল ব্যবহার না করে অথবা যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে নিজ উদ্যোগে উক্ত সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন। আর তাতে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর পরিবর্তে এ বাবদ সরকার প্রদত্ত অর্থের সাকুল্য পরিমান সচিবরা প্রাপ্ত হবেন।
বর্তমানে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে যারা বসবাস করেন ঐ সকল ফ্ল্যাট বাড়ির নিরাপত্তার বিষয়টি মালিক সমিতি কতর্ৃৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরীদের দ্বারা নির্বাহ করা হয়। এ ধরনের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য প্রতিটি ফ্ল্যাট মালিককে মাসিক নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এ অর্থ দ্বারা নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা, নৈশকালীন বৈদ্যুতিক বাতির সুবিধা এবং ক্ষেত্র বিশেষে লিফটের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিদ্যুৎ ব্যয় নির্বাহ করা হয়। একজন ফ্ল্যাট মালিককে এ বাবদ প্রতিমাসে যে অর্থ ব্যয় করতে হয় তা এলাকা ও সেবার মানভেদে ৩ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা সরকারি ফ্ল্যাট বাড়িতে বসবাস করেন। এ সকল ফ্ল্যাট বাড়ির বহিরস্থ বিদ্যুতের ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার কাজ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ ও পুলিশ বিভাগ প্রদত্ত জনবল দ্বারা নির্বাহ করা হয়। আর এ কারণে পৃথকভাবে সচিবদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নিরাপত্তা প্রহরী বা নিরাপত্তা প্রহরী ভাতা এ দুটির কোনোটিরই আবশ্যকতা আছে কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে।
পৃথিবীর কোনো দেশে সচিব বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকারের নিকট হতে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর সুবিধা বা ভাতা প্রাপ্ত হন না। এ ধরণের সুবিধা রাজতান্ত্রিক ও উপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার সাথে এ ধরনের সুযোগসুবিধা কখনো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণ মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এটি নিশ্চিতের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সেবার মানসিকতা। আর এটি নিশ্চিত করতে গেলে অবশ্যই নিজ সেবার পরিবর্তে জনসেবাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ