ইতিহাসে মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন
বনূ নুযায়ের হলো একটি গোত্রের নাম। গোত্রটি ছিল হযরত হারূন (আ.) এর সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে একটি ‘ইহুদী গোত্র’। তারা সিরিয়া থেকে মদীনায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। তারা ছিল মদীনা থেকে দুই মাইল দূরে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্বপ্রথম মদীনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্রসমূহের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু ওহুদ যুদ্ধের পর ‘বনূ নুযায়ের’ বিশ্বাসঘাতকতা ও গোপন দুরভিসন্ধি শুরু করে দেয়। একপর্যায়ে তাদের ধৃষ্টতা মুসলিমগণের ধৈর্যের সীমা পাড়ি দিল। তাই বাধ্য হয়ে রাসূল (সা.) মুসলিমবাহিনী নিয়ে তাদের সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘটনাক্রমে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলিমবাহিনী বিজয় লাভ করলেন কোনো প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই! বনূ নুযায়ের গোত্রের ধনসম্পদ হস্তগত হলো মুসলিমবাহিনীর হাতে। রাসূলুল্লাহ (সা.) কে ইখতিয়ার দেওয়া হলো সেসব ধনসম্পদ মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়ার। সে সময় মুহাজিরগণ ছিলেন একেবারে নিঃস্ব। তাঁদের না ছিল নিজস্ব কোন ঘর-বাড়ি এবং না ছিল কোনো বিষয়-সম্পত্তি। তাঁরা আনসারগণের গৃহে বাস করতেন এবং তাঁদেরই বিষয়-সম্পত্তিতে মেহনত মজদুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই সম্পদ হস্তগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আনসারগণের দলপতি— সাবেত ইবনে কায়স (রা.)-কে ডেকে বললেন, তুমি আনসারগণকে আমার কাছে ডেকে আনো। সাবেত জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার নিজের গোত্র ‘খাজরাজ’ এর আনসারগণকে ডাকব, নাকি সব আনসারকে ডাকব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, সবাইকে ডাকতে হবে। অতঃপর তিনি আনসারগণের এক সম্মেলনে ভাষণ দিলেন। হামদ-সালাতের পর তিনি মদীনার আনসারগণের অনেক অনেক প্রশংসা করে বললেন: ‘আপনারা আপনাদের মুহাজির ভাইদের সাথে যে সদয় আচরণ করেছেন, নিঃসন্দেহে তা অনন্য সাধারণ উদারতা-সাহসিকতা-বড় হিম্মতের কাজ। অতঃপর তিনি বললেন, মহান আল্লাহ তা’আলা বনূ নুযায়েরের ধনসম্পদ আপনাদের হস্তগত করে দিয়েছেন। যদি আপনারা চান, তবে আমি এই সম্পদ মুহাজির ও আনসার সবার মধ্যে বণ্টন করে দেব এবং মুহাজিরগণ পূর্বের ন্যায় আপনাদের গৃহেই বসবাস করবে। পক্ষান্তরে আপনারা চাইলে, আমি এই সম্পদ কেবল গৃহহীন ও সহায়-সম্বলহীন মুহাজিরগণের মধ্যেই বণ্টন করে দেব এবং এরপর তারা আপনাদের গৃহ ত্যাগ করে আলাদা নিজেদের গৃহ নির্মাণ করে নিবেন।এই ভাষণ শুনে আনসারগণের দুইজন প্রধান দলপতি— সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.) ও সা’দ ইবনে মুয়ায (রা.) দ-ায়মান হলেন এবং আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের অভিমত এই যে, এই ধনসম্পদ আপনি সম্পূর্ণই কেবল মুহাজির ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিন এবং তাঁরা এরপরও পূর্বের ন্যায় আমাদের গৃহে বসবাস করুন। দলপতিদ্বয়ের এই অভিমত শুনে উপস্থিত আনসারগণ সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা এই সিদ্ধান্তে সম্মত এবং আনন্দিত।
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল আনসার এবং তাঁদের সন্তানগণকে মনভরে দোয়া দিলেন। হস্তগত ধনসম্পদ বণ্টন করে দিলেন মুহাজিরগণের মধ্যে। আনসারগণের মধ্যে মাত্র দুই ব্যক্তি— সহল ইবনে হানীফ (রা.) ও আবূ দুজানা (রা.)-কে অত্যধিক অভাবগ্রস্ততার কারণে কিছু সম্পদ দিলেন এবং গোত্র-দলপতি সা’দ ইবনে মুয়ায (রা.)-কে ‘ইবনে আবী হাকীকের’ একটি বিখ্যাত তরবারি প্রদান করলেন। পরবর্তীতে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দ্বীপ-রাষ্ট্র ‘বাহরাইন’ বিজিত হল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রাপ্ত ধনসম্পদ সম্পূর্ণই আনসারগণের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দিতে চাইলেন; কিন্তু তখনও আনসারগণ তাতে রাজী হলেন না। বরং বললেন, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই গ্রহণ করব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মুহাজির ভাইগণকেও এই ধনসম্পদ থেকে অংশ না দেওয়া হয়! সুবহানআল্লাহ! নিঃসন্দেহে এ তো ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনের অনন্য প্রকাশ’!