
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা রসামৃত
অমল সরকার
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে- সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ। ‘উপনিষদ্ হচ্ছে সর্বশাস্ত্রের সার আর গীতা হচ্ছে উপনিষদের সারাৎসার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপালরুপে এই গাভীরুপী উপনিষদ্ হতে এবং পার্থরুপী বৎস সামনে রেখে দুগ্ধরুপী গীতার নির্যাস সুধীজনকে (ভক্তজনে) বিলিয়ে দিয়েছেন ।’
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৭০০টি শ্লোকের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের-০১, সঞ্জয়ের- ৪১, অর্জুনের- ৮৪ এবং অবশিষ্ট ৫৭৪টি শ্লোক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কথিত । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচ-ীর মতো ষট সংবাদরুপে পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবত বা শ্রীচ-ীর মতো গীতা শুরুতেই ষট প্রশ্ন এবং তার ব্যাখ্যা দিয়ে বিস্তৃত হয়নি । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুন কৃত দ্বাদশটি প্রশ্ন আছে সমগ্র গীতাব্যাপী এবং ভগবানও যেমন যেমন সংশয় এসেছে তেমন তেমন নিরসন করেছেন । সৃষ্টির আদিতে পরমাত্মার সংকল্প জাগে যে ‘আমি সৃষ্টি করব’, ‘আমিই বহুরুপে ধারণ করব’। ‘একৈবাহং বহুস্যাম প্রজাজেয়’। কিন্তু সৃষ্টি কেন ? ‘সৃষ্টা তু লীলা কৈবল্যম্’। এ হচ্ছে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার লীলাখেলা আর ভগবানের এই খেলায় জগৎ-সংসার, শরীরাদি হচ্ছে তার খেলার সামগ্রী। জীবসকল কিন্তু এই প্রকৃত খেলা ভুলে, খেলার সামগ্রী অর্থাৎ শরীরাদিকে নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে ভ্রান্ত ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয় এবং ভগবৎ বিমুখ হয়ে পড়ে । জীব যাতে ঈশ্বরমুখী হয় এবং ভগবানের সঙ্গে তার নিত্য যোগ (সম্বন্ধ) খুঁজে পায় সেইজন্য যোগশাস্ত্ররুপী ভগবদ্গীতার আবির্ভাব। গীতায় তাই যোগের মাহাত্ম্য অনেক এবং একে যোগশাস্ত্র (ভগবানের সঙ্গে ভক্তের যুক্ত হওয়ার পথ) বলা হয়েছে। তবে জীবাত্মা ও পরমাত্মার, ভক্ত ও ভগবানের, যোগী ও ঈশ্বরের পার্থক্য অনেক । ভগবানের যে জগৎসংসারের উৎপত্তি, স্থিতি, প্রলয় ইত্যাদির সামর্থ্য আছে, সে ক্ষমতা যোগীর থাকে না, ব্রহ্মসুত্র বলছেন ভক্ত ‘জগৎ ব্যাপারবর্জম্ (ব্রহ্মসূত্র, ৪/৪/১৯) অর্থাৎ যোগীর জগৎ সংসার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে না। তার ক্ষমতা হয় কেবল সংসারের ওপর বিজয়প্রাপ্তির, সংসারের অনুকূল পরিস্থিতির প্রভাব তার প্রতি না পড়ার ওপর ।
গীতায় অর্জুন যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করেননি, তিনি তার কল্যাণ প্রার্থনা করেছিলেন। ভগবান তাই শাস্ত্রাদিতে যতপ্রকার কল্যাণকর সাধন প্রনালী আছে যথা- কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ, প্রানায়াম, যজ্ঞ, দান, তপ ইত্যাদি সকল সাধন প্রানালীই গীতায় সংক্ষেপে অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। গীতায় কোথাও কাউকে সম্প্রদায় বা সাধনপথ পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পরিমার্জনের কথা; তাই সাধকজগতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বিশেষভাবে সমাদৃত । তবে সমস্ত যোগ বা ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সকল সাধনের মধ্যে ‘কর্মযোগ’, ‘জ্ঞানযোগ’ ও ‘ভক্তিযোগ’ই বিশেষভাবে প্রচলিত। তাই ভগবান গীতায় এই তিনটি যোগই মুখ্যরুপে বলেছেন। ভাগবতেও শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব সংবাদে ভগবান বলেছেন- যোগাস্ত্রয়ো ময়া প্রোক্তা নৃণাং শ্রেয়োবিধিৎসয়া। জ্ঞানং কর্ম চ ভক্তিশ্চ নোপায়োন্যোহস্তি কুত্রচিৎ।।(ভাগবত ১১/২০/৬)
‘নিজ কল্যাণকামী ব্যক্তিগণের জন্য আমি তিনটি যোগপথ বলেছি -জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ অ ভক্তিযোগ । এই তিনটি ছাড়া কল্যাণ লাভের আর কোনো পথ নাই।’
এর মধ্যে যার কর্মে অধিক রুচি ও আগ্রহ থাকে তিনি কর্মযোগের অধিকারী, যার মধ্যে নিজেকে জানার আগ্রহ প্রবল তিনি জ্ঞানযোগের অধিকারী এবং যার মধ্যে ভগবানে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেশি তিনি ভক্তিযোগের অধিকারী। এই সকল যোগপন্থাই পরমাত্মা প্রাপ্তির পৃথক পৃথক সাধন এবং আর যা কিছু সাধন আছে সবই এই তিন সাধনার অন্তর্গত ।
লেখক : সম্মানীত ট্রাস্টী হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট
