
সনাতন ধর্ম কী?
আশালতা বৈদ্য
বর্তমান জগতে ধর্ম বলে আমরা সাধারণত : যা বুঝি, সনাতন ধর্ম ঠিক তা নয়। কোনো একটি বিশ্বাসকে সাধারণ লোক ধর্ম বলে ভাবে। এই বিশ্বাসের পরিবর্তন হতে পারে, আজ যার ওপর বিশ্বাস আছে কাল তার ওপর বিশ্বাস না থাকতে পারে।
বিশ্বাসের পারিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সনাতন ধর্ম বলে যা বুঝা যায় তার পরিবর্তন হয় না। জল থেকে যেমন তার তরলতা কখনই বাদ দেওয়া যায় না, অগ্নি থেকে যেমন তার তাপ ও আলোক বাদ দেওয়া যায় না, তেমনই জীবের সঙ্গে সনাতন ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে রয়েছে। এটিই জীবের স্বাভাবিক ধর্ম। এটির কোনো আদি নেই কিংবা অন্তও নেই। এই ধর্ম কোনো সময় সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। এই ধর্ম সমস্ত জীবের ধর্ম। তাই এটিকে কোনো প্রকারে সীমিত করে রাখা যেতে পারে না। তথাপি কতক সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি মনে করেন যে, ‘সনাতন ধর্ম’ একটি সাম্প্রদায়িক ধর্ম, কিন্তু এটি তার দৃষ্টিভঙ্গীর সংকীর্ণতা এবং বিকৃত বুদ্ধিজাত অজ্ঞতার প্রকাশ। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষীতে সনাতন ধর্মের যথার্থতা বিশ্লেষণ করি তখন দেখতে পাই যে এই ধর্ম পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের ধর্ম; কেবল তাই নয়, এই ধর্ম সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মা-ের প্রত্যেক জীবের ধর্ম।
অসনাতন ধর্ম-বিশ্বাসের সূত্রপাতের ইতিহাস পৃথিবী ইতিহাসের বার্ষিক পঞ্জিকাতে লেখা থাকতে পারে, কিন্তু সনাতন ধর্ম-সূত্রপাতের কোনো ইতিহাস নেই। কারণ সনাতন ধর্ম সনাতন জীবের সঙ্গে সর্বদা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে সর্বকালে বর্তমান। জীব সম্বন্ধে শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে সে হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর অতীত। ভগবদ্?গীতায় বলা হয়েছে যে তার জন্ম নেই কি মৃত্যু নেই, সে শাশ্বত, অবিনশ্বর এবং তার জড় দেহের মৃত্যু হলেও তার শাশ্বত স্বরূপের কখনই মৃত্যু হয় না। সংস্কৃতে ‘ধর্মে’-এর অর্থ হল- যা অপরিহার্য অঙ্গরূপে কোনো ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে জড়িত। যেমন তাপ ও আলোক অগ্নির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাপ ও আলোক বিনা অগ্নির কোনো প্রকার পরিপ্রকাশ হতে পারে না। তেমনই জীবের অপরিহার্য অঙ্গ কি? জীবের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে কিভাবে? নিত্য বিরাজিত সেই জিনিষটি কি? তার এই নিত্য-সঙ্গী হচ্ছে তার শাশ্বত প্রকৃতি এবং এবং এই শাশ্বত প্রকৃতিই হচ্ছে তার সনাতন ধর্ম।
সনাতন গোস্বামী যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন- ‘জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস।’ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর উক্ত উক্তিটি যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে, প্রত্যেক জীব সর্বক্ষণ কোনো না কোনো জীবের সেবায় ব্যস্ত। এইভাবে অপরের সেবা করার মাধ্যমে জীব নিজস্ব জীবন উপভোগ করে। নিম্নস্তরের পশু, ভৃত্য যেমনভাবে পশুর সেবা কার্য করে, তেমনিভাবে সে মানুষের সেবা করে থাকে। মানুষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই যে ‘ক’, ‘খ’ প্রভুর সেবা কার্যে ব্যস্ত; এইভাবে সমস্ত ‘খ’, ‘গ’ প্রভুর সেবা কার্যে ব্যস্ত; ‘গ’, ‘ঘ’ প্রভুর সেবা কার্যে ব্যস্ত; এইভাবে সমস্ত জীব অন্য কোনো না কোনো এক জীবের সেবা করে চলেছে। আমরা দেখতে পাই যে বন্ধু বন্ধুর সেবা করছে, মা সন্তানের সেবা করছে, স্ত্রী স্বামীর সেবা করছে, স্বামী স্ত্রীর সেবা করছে, রাজনীতিজ্ঞরা জনগণের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভোট দাবী করছে। দোকানদার খরিদ্দারের সেবা করে, শিল্পী ধনিক-সম্প্রদায়ের সেবা করে, ধনিক-সম্প্রদায় তাদের পরিবারের সেবা করে, পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সমাজ সেবা করে থাকে, এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো এক জীব অন্য কোনো এক জীবের সেবা না করে থাকতে পারে না। এ থেকে অনুমিত হয় যে সেবাই হচ্ছে জীবের শাশ্বত ধর্ম।
তবে মানুষ দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টিয়ান, বৌদ্ধ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করার ফলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে পড়ে। এই ধরণের ধর্ম বিশ্বাস কখনই সনাতন ধর্ম নয়। কোনো হিন্দু তার বিশ্বাসের পরিবর্তন করে মুসলমান হতে পারে অথবা কোন মুসলমান তার বিশ্বাস পরিবর্তন করে হিন্দু হতে পারে, কিন্তু উক্ত ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন হলেও অপরের সেবা করার যে শাশ্বত ধর্ম তাকে ত্যাগ করে মানুষ কখনই থাকতে পারে না।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টিয়ান যে কোনো ধর্মাবলম্বী হোক না কেন মানুষ প্রত্যেক মুহূর্তে অপরের সেবা করে চলেছে। তা বলে কোনো ধর্ম গ্রহণ করা এবং সনাতন ধর্মের আচরণ করা একার্থ বোধক নয়।
ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হচ্ছে সেব্য-সেবক সম্পর্ক। পরমেশ্বর হচ্ছেন পরম ভোক্তা, এবং আমরা সবাই হচ্ছি তার পরিচারক। ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য যদি সর্বদা তার সেবা করে চলি তাহলে আমরা সুখী হতে পারবো। এছড়া অন্য কোনো প্রকারে সুখী হওয়া সম্ভবপর নয়। উদরকে বাদ দিয়ে শরীরের কোনো অন্য কোনো অঙ্গ যেমন সুখী হতে পারে না, তেমনই ভগবানকে বাদ দিয়ে আমরাও কোনো প্রকারে সুখী হতে পারব না।
তাই আমাদের সর্বস্ব দান করে আমাদেরকে ভগবানের সেবা করতে হবে; এই সেবা করাই আমাদের স্থিতির একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এই সেবা করার মাধ্যমেই আমরা দিব্যানন্দ আস্বাদন করতে পারব
