
দ্বীপাবলির তাৎপর্য
ধীরেন্দ্র নাথ বারুরী
কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন Ñ-
‘কে যেন ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো ঘরে ঘরে।
জ্বালাও আলো আপন প্রাণে আলোয় সাঁজাও আলোয় ধরিত্রীরে’।
সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি বিশেষ মহিম্বান্বিত রজনী। পূর্ব দিকে উদিত সূর্য পশ্চিম দিকে অস্তমিত হওয়ার পর শুরু হবে দ্বীপ জ্বালানো। অঞ্চল ভেদে উৎসবকে দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। আজ সন্ধ্যার আগে মাটির প্রদীপ সাজানো হবে। অথবা কলা গাছের সতেজ খোল দিয়ে তৈরি করা হবে প্রদীপ।
তেলে জড়িয়ে সলতে প্রদীপে রাখা হবে। মোমবাতিও আনা হবে। কলার খোল দিয়ে বড় বড় করে কয়েকটি ডুঙ্গা তৈরি করে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো হবে। তাতে ধূপ জ্বলবে কাঁসরের শব্দে আলতো হাতের স্রোতে ভাসবে প্রদীপ, সেই প্রজ্বলিত প্রদীপে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে। পিতৃদেব-মাতৃদেবী কিংবা পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে উদ্যত জোড় হস্তে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
প্রত্যেক সার্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করা হয়। আলোকসজ্জার এই দ্বীপাবলিতে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালানোর দিন। নিজের ভেতরের বাহিরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে- এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক। আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন- আত্মাকে প্রজ্জ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন। রামায়ন অনুসারে আজকের দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রামরাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রী রামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশীতে শব্দবাজি করে। অনেকে মনে করেন দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে।
দীপাবলী মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। দীপাবলীর আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরক চতুর্দশী’, এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন, কিন্তু এই দিনই মূল হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন রাতে শাক্তরা শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন। তাছাড়া এই দিনে লক্ষীপূজাও করা হয়, কথিত আছে এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরধাত্রী রূপে ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। বিষ্ণুপুরান মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; এই দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুত প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। দীপাবলীর তৃতীয় দিন- কার্তিকা শুদ্ধ, এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে। চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্ত্রণ করে, কপালে ফোঁটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়। রামায়ন মতে বিজয়া দশমীতে রাবন বধ এবং দ্বীপাবলির দিনে শ্রী রামচন্দ্রের অযোধ্যায় আগমন। তাই অনেকেই মনে করেন দীপাবলির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় শারদীয় দূর্গোৎসব। আসলে এ ধারনা সঠিক নয়। শাস্ত্র মতে-শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষ। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ সাঙ্গ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম মহালয়া। পুরাণে আছে, সৌর উত্তরায়ণকালে বিষ্ণুলোকে যখন দিন, যমলোকে তখন রাত-দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণের ছয় মাস দেবতারা জেগে থাকেন, বিষ্ণুলোকের তোরণ থাকে অবারিত। দক্ষিণায়নের ছয় মাস দেবতারা নিদ্রিত। কিন্তু যমলোকে দিনমান, দুয়ার খোলা। আজ দক্ষিণায়নের প্রথম দিনে ঘুম ভেঙে বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসেন মর্ত্যলোকে। এ সময় তারা থাকেন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত হন। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরণ করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন।
মহালয়াতে অনেকে গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্মার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয়, পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা – অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও যারা জন্ম জন্মান্তরের আমার আত্মীয়-বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন। যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয়। যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু – অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্মারা তৃপ্তিলাভ করুক।
কালীর আবির্ভাব তিথি ও দীপাবলী Ñ-
কালী বিলাসতন্ত্রে বলা হয়েছে Ñ-
কার্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটি ভিঃ সহা।।
অর্থাৎঃ কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার মহানিশিতে মহাদেবীর এই ভূ-মন্ডলে আবির্ভাব। এটাই তার আবির্ভাব তিথি। এদিন দীপাবলী বা দীপদান তথা দেওয়ালী রজনী। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে দীপদানে আলোক মালায় প্রজ্জ্বলিত করে নিজেদের অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর দীপাবলী। আলোর মাধ্যমে শক্তি সাধনায় নিজেকে পুণ্যালোকে আলোকময় করে তোলাই জগতের মূলে শক্তি সাধনার অন্তনির্হিত তাৎপর্যের সার্থকতা।দ্বীপাবলি সবার জীবনে সুখ নিয়ে আসুক। ঘুচে যাক সকল অন্ধকার, মুছে যাক সকল যন্ত্রনা। জ্বলুক শান্তির প্রদীপ;ভালবাসার প্রদীপ জ্বলুক।
