
হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গে
নিতাই চাঁদ তালুকদার
হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন এ ধর্ম দুর্বোধ্য ও অযৌক্তিক। এরূপ মনে করার কারণ এর বিশালত্ব, যা অনায়াসলভ্য নয়। কতগুলি বিশ্বজনীন মৌলিক সত্য রয়েছে এবং বিভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গীতে নিরূপিত সে সত্যের উপর হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এ যেন বিশাল এক অশ্বত্থ বৃক্ষ! এর শাখা-প্রশাখা অসংখ্য। অনেকে এর কোনটি শাখা, কোনটি উপশাখা বুঝতে পারেন না। কাজেই যে কোন একটি শাখা বা উপশাখাকে ধরে হিন্দু ধর্মকে বুঝতে গিয়ে ভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। আবার এর যে কোন একটি শাখা বা প্রশাখা হিন্দু ধর্মের সার্বিক পরিচায়ক নয়। আমরা জানি যে শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব প্রভৃতি অনেক সম্প্রদায় রয়েছে হিন্দু ধর্মে ।
দ্বৈত, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত কত মতবাদ; জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, যোগ-কত মার্গ! এগুলো ধর্মের সোপান। কাজেই কোন পথ অবলম্বন করা উচিত তা নির্ণয় করা একটু কঠিন বৈকি! কঠিন হলেও এর সমাধান আছে। বিশেষ বিবেচ্য যে, এর কোন একটিকে বাদ দিলে হিন্দু ধর্মের সার্বিক রূপ পাওয়া যাবে না। আসলে এসব ভিন্ন মতবাদ সকলই সমসূত্রে গাঁথা। এসূত্রটি হল বেদচতুষ্টয়। বেদ হিন্দুর মূল ধর্ম গ্রন্থ। এ ধর্মগ্রন্থে কি আছে, আর কি নেই সে বিষয়ে অবহিত হয়ে হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে ধারণা করা সমীচীন। বেদ অর্থে জ্ঞান। যে সব মতবাদ বা ভাবাদর্শ বেদকে প্রমাণ বলে গ্রহণ করে না বা উপনিষদে সংগৃহীত বেদের সারতত্ত্বগুলিকে গ্রহণ করে না, সেসব মতবাদকে হিন্দধর্মের অঙ্গ বলা যায় না। উপনিষদসহ শ্রুতিকে বেদ বলা হয়। এটি কোন ব্যক্তিবিশেষের রচিত নয়। পরমার্থ তত্ত্ব ঋষিগণের উপলব্ধ এবং গুরশিষ্যপরম্পরায় শ্রুত বলে এর নাম শ্রুতি। যুগ যুগ ধরে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি দ্বারা এ জ্ঞান আহরণ করা হয়েছে। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণের এ অতীন্দ্রিয় জ্ঞান জড় বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা নিশ্চয়ীভূত হয় না। দ্রষ্টার অনুভূতি অঙ্কশাস্ত্রের মত অভিন্ন না-ও হতে পারে। এতদসত্ত্বেও ঋষিগণের পুঞ্জীভূত অনুভূতির মধ্যে এ মৌলিক ভাবধারায় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে এদের তুরীয় দর্শনের সত্যতা প্রমাণিত। কাজেই বেদ স্বপ্রমাণ ও স্বপ্রকাশ। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখার প্রবক্তাদের মধ্যে কিছু গৌণ অনুসিদ্ধান্ত ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে; কিন্তু মৌলিক তত্ত্বে মতভেদ নেই। এ পার্থক্যগুলো দেখে সাধারণ মানুষ বিচলিত হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকে যায়- আধ্যাত্মিক জীবনের উচ্চস্তরে আরোহন না করে এসব সূত্র তত্ত্বগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যার নিগুঢ়তা উপলব্ধি করা অসম্ভব নয় কি? এ বিড়ম্বনা মাত্র। কাজেই এসব বিষয়ের ভ্রান্ত ধারণা বর্জনীয়। হিন্দু ধর্মের সারতত্ত্ব বেদান্তে। শ্রী মদ্ভগবদগীতা বেদান্তের সার। স্বামী বিবেকানন্দ গীতাকে বেদান্তের দৈবভাষ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ ধর্মের মূল উৎসগুলিতে সাম্প্রদায়িক মতবাদের কোনো স্থান নেই। এতে আছে কিছু দেবাতাত্মা মানুষের নৈর্ব্যক্তিক পারমার্থিক অনুভূতি। সর্বস্তরের দর্শন, কবিতা ও সঙ্গীত একীভূত হয়েছে এ ধর্মে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অসংখ্য মনীষীগণ সর্বজনীন এ ধর্মতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন গভীরভাবে। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের উপলব্ধি লক্ষ্যনীয়- ‘সারা পৃথিবীতে বেদান্তের ন্যায় এত উন্নত ও মঙ্গলদায়ী পাঠ্য কিছু নেই। জীবিত অবস্থায় আমি এ থেকে সান্ত¡না পেয়েছি, মৃত্যুকালে পাব প্রশান্তি।’ সুপ-িত ম্যক্সমূলারের উপলব্ধি- ‘পৃথিবীতে যত দার্শনিক মতবাদ আছে তার মধ্যে বেদান্ত সর্বাপেক্ষা মহীয়ান এবং যত ধর্মমত আছে তার মধ্যে বেদান্ত সর্বাপেক্ষা শান্তিদায়ক।’ যে সব মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিশেষ বিকাশ ঘটে তাকে অমূর্ত ব্রহ্মের প্রতিভূ বলা হয়, এবং তিনিই অবতার। শাস্ত্রে এর উল্লেখ আছে। এসব লক্ষণযুক্ত হলে অপর ধর্মের প্রবর্তককে অবতার বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না। হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ এভাবে শ্রী রাম, শ্রী কৃষ্ণের মত বুদ্ধকেও অবতার বলে মানে। সেভাবে হিন্দুরা বৌদ্ধ-খ্রীস্টান না হয়েও বুদ্ধ ও খ্রীস্টের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কুণ্ঠা বোধ করে না। এভাবে হিন্দু ধর্মে উদারতাই পরিলক্ষিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ধর্ম হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব।’ ‘ব্রহ্মৈব স্যাং ব্রহ্মাপ্যোতে’ মানুষের মধ্যে এ দেবত্বের বিকাশ দেখে স্থান-কাল-জাতি-নির্বিশেষে হিন্দুরা শ্রদ্ধা জানায়। কেউ যদি একজন অবতার বা ভগবৎ প্রতিনিধির নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন না করে অবতারের বাণী গ্রহণ করে তাহলে সে ব্যক্তি ধর্ম থেকে পতিত হবে বা স্বর্গের দ্বার তার জন্য চিরতরে রুদ্ধ হবে, হিন্দুধর্ম তা স্বীকার করে না। ঈশ্বরানুভূতি বা ব্রহ্মজ্ঞান যদি ধর্মের লক্ষ্য হয়ে থাকে এবং ভগবৎ প্রেরিত নররূপী ভগবান নানা যুগে নানা পথের সন্ধান দেন, তাহলে এর যেকোনো একটি নিষ্ঠার সাথে অবলম্বন করে চললে একই গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। শ্রী ভগবান গীতামুখে বলেছেন- যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।স মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ। (গীতা-৪/১১)
যে যেভাবে আমার শরণাপন্ন হয় আমি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করি। অতএব দেখা যাচ্ছে হিন্দুধর্মে অন্ধবিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। কিন্তু যারা জলে না নেমে সাঁতার শিখতে চায় তাদের কোনো কালেই সাঁতার শেখা হয় না। যারা ধর্মের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেছেন, অথচ পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের প্রশ্নের মীমাংসা প্রয়োজন। সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করা দরকার। এদের আমরা আচার্য বা গুরু বলতে পারি। শাস্ত্রে আছে- যে পর্বত আরোহন করে ফিরছে তার কাছে পরবর্তী পথের সন্ধান আস্থা সহকারে জেনে নেওয়া প্রয়োজন (ছা উপ) সেরূপ ধর্মপথের উচ্চশিখরে উপনীত হতে হলে আচার্যের কথায় আস্থা না রাখলে চির জীবনই ব্যতিরেকে জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সর্বভূতে সমদর্শন ও সর্বভূতের কল্যাণ সাধনই হিন্দুধর্মের বিশেষ লক্ষ্য। ভগবান সৃষ্টির প্রতি অণুতে বিরাজমান। প্রত্যেক জীবের অন্তরে আত্মার উপলব্ধি করতে না পারলে সৃষ্টিকর্তাকে দেখা যায় না। (ঈশ-উপ-৫-৬, গীতা ৪/৩৫)
সকলের মধ্যে নিজেকে অনুভব করতে না পারলে সম্পূর্ণভাবে অপরের জন্য ব্যথিত হওয়া যায় না। (গীতা ৬/৩২)। এ ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত হিতের কথা বলে না। বিশ্ব জগতের মঙ্গলের কথা গভীরভাবে বলে। তাহলেও কি এ ধর্মকে স্বার্থপরতার ধর্ম বলা যায়? সত্য অনুভব না করে সমালোচনা করলে সমালোচিত হওয়ারই সম্ভাবনা। তাই আধ্যাত্মিক জীবনের চরম শিখরে উন্নীত হয়েও যোগীকে লোকসংগ্রহ কর্মে (গীতা ৩/২০) ও সর্বভূতহিতে রত(গীতা ৫/২৫) থাকতে উপদেশ দিচ্ছেন শাস্ত্র।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উর্যাপন পরিষদ, নবাগঞ্জ থানা
