হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী : বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।’ যে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া আমরা নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি না, এ তাঁরই কথা। বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অন্তরের অকৃত্রিম আকর্ষণের পরিচয় মেলে বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত তাঁর প্রবন্ধে, নানা সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে, গানে ও কবিতায়। এই দুর্বলতা যে কবির সাময়িক ব্যাপার মাত্র ছিল না, ছিল মজ্জাগত, তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বসিত মূল্যায়ন, যা তাঁর আবেগ ও যুক্তিকে সমন্বিত করেছে। দীর্ঘদিনের ব্যবধানের ফলেই কবির পক্ষে বুদ্ধের মহত্ব অনুধাবণ করা সহজতর হয়েছে। সমসাময়িক কালে নিরপেক্ষভাবে সার্বিক মূল্যায়ন করা যে সম্ভব হত না, পরবর্তীকালে তাই সম্ভব হয়েছে কবির পক্ষে; বুদ্ধকে কবি ‘যথাস্থানে মানবমনের মহাসিংহাসনে মহাযোগের বেদীতে অধিষ্ঠিত দেখেছেন। মানব কর্তৃক মহামানবের স্বীকৃতি ঘটে মহাযুগের পটভূমিকায়। পৃথিবীতে যাঁরা খ্যাতিমান বলে স্বীকৃত, লক্ষিত হয় তাঁদের খন্ড প্রকাশ। পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রকাশ সেইসব বিরল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ঘটে, যাঁদের চেতনা কোনো কারণেই খ-িত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন মানুষের সত্যস্বরূপ বুদ্ধের হৃদয়ে দেদীপ্যমান। সকল জীবকে তিনি নিজের মতো করেই জেনেছিলেন, সকলকে তিনি নিজের বিরাট হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলেন। বিরল সংখ্যক মানুষই আবির্ভূত হন সকল মানুষের জন্য এবং সকল কালের জন্য। এঁরাই মহামানবের স্বীকৃতি লাভ করেন, যেমনটি লাভ করেছিলেন বুদ্ধ। রাজসম্পদ স্বেচ্ছায় পরিহার করে বুদ্ধ তপস্যায় মগ্ন হয়েছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল সব মানুষের দুঃখমোচন। বিশেষ কোন মানুষের স্বার্থ রক্ষায় তাঁকে উদ্যোগী হতে দেখা যায় নি। তাঁর তপস্যায় ছিল নির্বিচারে সকল দেশের সকল মানুষের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ। প্রশ্ন হতে পারে সত্য সত্যই বুদ্ধের প্রয়াস কি সার্থক হয়েছে? সব মানুষের দুঃখ কি তিনি দূর করতে পেরেছেন? এর উত্তরে বলতে হয় নিছক ফলাফলের নিরিখে কোন কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না সব সময়। মূল্যায়নে গুরুত্ব দিতে হয় অভিপ্রায়ের ওপরও। বুদ্ধের মূল্যায়নে কবিও সেই অভিপ্রায়ের ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন-‘একদিন বুদ্ধ বললেন আমি সমস্ত মানুষের দুঃখ দূর করব। দুঃখ তিনি সত্যই দূর করতে পেরেছিলেন কি-না সেটি বড় কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে তিনি এটি ইচ্ছা করেছিলেন, সমস্ত জীবের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতবর্ষ ধনী হোক, প্রবল হোক,- এ তাঁর তপস্যা ছিল না, সমস্ত মানুষের জন্য তিনি সাধনা করেছিলেন। আজ ভারতের মাটিতে আবার সেই সাধনা জেগে উঠুক। সেই ইচ্ছাকে ভারতবর্ষ থেকে কি দূর করে দেওয়া চলে!