বুদ্ধের আহ্বান: আসুন, দেখুন, নিরীক্ষা করুন
চন্দন রিমু : সমগ্র বিশ্বে মানুষের পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি ও হৃদয়ে যেকজন ব্যক্তি মুক্ত শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে আছেন, তাঁদের অন্যতম গৌতম বুদ্ধের জন্ম, অশান্তিতে দগ্ধ মানবসমাজের জন্য প্রশান্তির আশীর্বাদ।মানুষের ইতিহাসে সেই প্রথম মানুষ শুনেছে অন্তর ও বহির্জগতের পূর্ণ মর্যাদা দানের দেশনা। মানুষ নিজেই প্রভু, নিজেই আশ্রয়, মানুষের বাইরের কোনো আশ্রয় নেই, প্রভু নেই। অন্তর্গত প্রেরণা মানুষের মৌলিক সম্পদ। এই সম্পদ ব্যবহারে কর্ষিত হয় ঐশ্বর্য। আসুন, দেখুন, নিরীক্ষা করুন ছিলো সকল মানুষের প্রতি বুদ্ধের আহ্বান। বৈষয়িকতার সংঘাতে আমৃত্যু লড়ে যাওয়া ক্লান্ত ও জীর্ণ মানুষ, তাঁর দেশনায় মনোযোগ কম সময় দিতে পেরেছে। মানুষের অবিরত সংঘাতের চোখে ধূসর হয়ে আছে বুদ্ধের দেখানো প্রেম ও প্রজ্ঞার সজীবতা। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, মিথ্যাদৃষ্টিপরায়ণ নিষ্ঠুর মানুষের সমাজ, নিজের জন্যও অহিতকর। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষের জন্য হিতকর কর্ম ইহজাগতিক সঙ্কটের কার্যকর সমাধান। ভ্রমযুক্ত বিশ্বাস ও যুক্তির চাতুর্যে যেকোনো প্রকার সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়, এই বোধ যতো দ্রুত জাগবে, মানুষ হবে অভ্রান্ত চৈতন্য ও হৃদয়ের নিকটবর্তী, এতে বিশ্ব হবে সুন্দর, কল্যাণকর। সচেতন মানুষ মাত্রেই জানেন, স্নায়ুচাপ থেকে মুক্ত স্বর্গীয় মানব-বিশ্ব ছিলো বুদ্ধের স্বপ্ন ও ঠিকানা। অসম্ভব আর অপরিবর্তনীয় কিছু নেই, সবকিছুই পরিবর্তনশীল ও ক্ষণিক জগতে স্বনিয়ন্ত্রিত মানুষ আপন আলোয় হাঁটতে পারে, সহজ, সুন্দর, সচেতন হতে পারে। অর্থপূর্ণ মানুষ হবার অনন্ত গুণরাশি আছে মানুষের। সুবোধ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করলে মানুষের দ্বারা অসম্ভব নয় আত্মনির্ভরশীল ও সঠিক দৃষ্টিপরায়ণ মানবসমাজের নির্মাণ। দরকার ব্যক্তি ও সমাজজীবনের উপায়, কায়িক-বাচনিক-মানসিক কর্মের সততা ও সৌন্দর্য। পরিত্যাজ্য সকল অমার্জিত ও অস্বাস্থ্যকর সংস্কার। সর্বত্র ছড়াক সুচিন্তা-সুবচন ও সুকর্মের স্মরণ।
চিরতরে রোধ হোক মানুষের উপর প্রতিষ্ঠিত ন্যায় ও অন্যায় নামের উভয় নিষ্ঠুরতা। বহুবিচিত্র জাত্য গরিমা, আঞ্চলিকতার গরিমা এবং লৈঙ্গিক গরিমা ও বৈষম্য পরিত্যাগ করে মানুষ শুধু মানুষের উন্মুক্ত সন্তান হয়ে দিকে-দিকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। স্বীকার করুক বিশ্বের সকল মানুষ নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণভাবে একে অন্যের হিতকামী হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার।
গৌতম বুদ্ধকে সমগ্র মানবসমাজ থেকে খ-িত করে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরু হিশেবে দেখার বহুদিনের চর্চিত সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করা উচিৎ, জাতপাত-গোত্র-লিঙ্গ বিভাজনের উর্ধ্বে সম্পূর্ণ মানুষের দিকে আলোকপাত করে বুদ্ধ প্রচার করেছিলেন প্রেম ও প্রজ্ঞার শিক্ষা। তাঁর শিক্ষার মূলকেন্দ্রে ইশ্বর-আত্মা- দেবতারা নয়, স্থান পেয়েছে মানুষ আর জাগতিক দুঃখ থেকে মানুষের নিষ্কৃতি। ‘আসুন, দেখুন, নিরীক্ষা করুন’ এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সচেতন মানুষেরা নিজ-নিজ যুক্তি-বোধের কষ্টিপাথরে যাচাইবাছাই করে দেখতে পারেন, বুদ্ধের দেশিত শিক্ষা আদৌ সমগ্র বিশ্বে মানুষের সৌন্দর্য ও কল্যাণের নিশ্চয়তা প্রদান করে কি-না।
যে ভাবনায় আসে মানবজন্মের পূর্ণতা, বিপুল সৌন্দর্য ও শান্তি সেই বোধের-ভাবনা ভাবিয়ে তুলুক, শান্ত করুক অশান্ত মানববিশ্ব।
প্রত্যাশা সকল মানুষের প্রতি, দেশ-কাল-ধর্ম-গোত্রের বৈরিতা এবং লিঙ্গ-অসাম্যতার পক্ষে নিষ্ঠুর অবস্থান পরিহার করে জ্বলে উঠুন আত্ম এবং পরহিতকারী মুক্ত মানববাতি।