
বৌদ্ধধর্ম : মানবকল্যাণের দর্শন
মুহম্মদ সবুর : তিনি, গৌতম বুদ্ধ, জন্মেছিলেন আড়াই হাজার বছরেরও আগে এই উপমহাদেশে। যিনি বিশ্বাস করতেন, মানব কল্যাণ, মানব মুক্তি, মানব মৈত্রী আর মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সম্প্রীতিই জগতকে শান্তির পরিধিতে আশ্রিত করতে পারে। হিংসাকবলিত এই পৃথিবীতে তাঁর জন্মের ক্ষণ ছিল বৈশাখি পূর্ণিমাতে। তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই বৈশাখি পূর্ণিমাতে শুধু আবির্ভাব নয়, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহাপরিনির্বাণও এই তিথিতেই। নিজের মধ্যে বিশ্বমানবের সত্যরূপ প্রকাশ করে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর দর্শনে অন্ধ বিশ্বাসের কোনোও স্থান নেই। যুক্তি এবং বিচারই এখানে গ্রহণ বা বর্জনের শেষ কথা। তাঁর সময়ের পৃথিবীতে হিংসা, অবিশ্বাস, প্রেমহীনতা এবং লোভ-লালসা প্রায় মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বাতাবরণে বুদ্ধ অহিংসা, নির্লোভ, ক্ষমা এবং প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন। বুদ্ধর মতে, মৈত্রী হচ্ছে সবপ্রাণীর প্রতি কল্যাণ কামনায় ব্রতী হওয়া। মৈত্রীর সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘মা যেমন তার স্বীয় একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা করে, তদ্রুপ সব প্রাণীর প্রতি অপ্রেমেয় মৈত্রী প্রদর্শন করবে।’ এ মহামৈত্রীই শত্রুকে মিত্র, দূরের মানুষকে কাছে আনার ধারক ও বাহক। এটাই বিশ্বভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও নৈকট্য গড়ে তোলার চাবিকাঠি। এতে মানুষের সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা বিদূরিত হয়। জাতীয় সংহতি বিধানে ও বৈশ্বিক সম্পর্কোন্নয়নে মহামৈত্রী এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই মানুষের প্রতি গৌতম বুদ্ধের অমর অবদান ‘বিশ্বমৈত্রী’। এই বিশ্বমৈত্রী কিন্তু শ্রেণী বা সম্প্রদায়গত নয়। সর্বজনীন মানবধর্ম রূপেই স্বীকৃত।
এই বিশ্বে জন্ম নিয়ে বৌদ্ধ করুণাঘন অন্তরে যে দর্শন ও বাণী পরিবেশন করেছেন, তাতে বিশ্বমৈত্রীই ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিশ্বের সকল প্রাণীর সার্বিক মঙ্গলের জন্য তাঁর পরিবেশিত দর্শন ও বাণী পৃথিবীতে এক অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা করে। হিংসা-দ্বন্ধযুক্ত সমাজের বিপরীতে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নির্মাণে মৈত্রীময় চেতনাকে স্থাপন করার কথা বলেছেন বুদ্ধ। বিশ্বমৈত্রীর ভাবনা ছাড়া মানুষের সুখ-শান্তি যে সম্ভাবনারহিত, আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধ তা উচ্চারণ করেছিলেন। চেয়েছিলেন ‘তুমি যেমন সুখে থাক, অপরকেও সুখে থাকতে দাও’। বুদ্ধের মৈত্রী ভাবনাই তো হচ্ছে, অপরের সুখ ও হিত কামনা করা। সৃষ্ট জগতকে খন্ড খন্ড করে নানা দেশ, নানা জাতি হিসেবে দেখার নাম যে মানবতা নয়, তা উল্লেখ করে বুদ্ধ বলেছিলেন, সমস্ত বিশ্ব ও প্রাণীলোককে অখন্ড হিসেবে দেখার নামই মানবতা। মানুষ মাত্রই সমান। মানুষের প্রতি মানুষের হিংসা ও বৈষম্য পরিহার করতে হবে। ধর্মের বা দেবতার নামে প্রাণীবধ বন্ধ করতে হবে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলবে না। মানুষকে তার আপন মর্যাদা দিতে হবে। কোনো প্রাণীকে হিংসা করা যাবে না। সব প্রাণীর প্রতি দয়া ও মৈত্রী পোষণ করতে হবে।
বিশ্বে যখন বিপন্ন মানবতা, মনুষ্যত্ব বিকাশের চরম বিপর্যয় অবস্থা, ধর্মের নামে অর্ধমের প্রসার- তখন বুদ্ধের আবির্ভাব। বর্ণে বর্ণে জাতিতে জাতিতে দ্বন্ধ সমাজজীবনকে করেছিল প-। যখন হানাহানি, অহিংসা, অশান্তি, বিবাদ, দ্বন্ধ, বৈষম্য মানুষকে নিপীড়নের শিকারে পরিণত করেছে, অধিকারহারা মানুষের গরিষ্ঠতা কেবলই বেড়ে চলেছে, তখন এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ব্যাকুল মানুষ। কিন্তু কে তাদের উদ্ধার করবে পরিস্থিতি তখন এমনই এক সংশয়ে দোলায়িত।
আড়াই হাজার বছর আগেও বিশ্ব পরিপূর্ণ ছিল হানাহানিতে। দূর্যোগের কালো মেঘ ছিল সর্বত্রই। প্রেম, প্রীতি, উদারতা, করুণা, স্নেহ, মমতা প্রভৃতি মানবিক গুণগুলো লোপ পেতে বসেছিল। শ্রদ্ধা, ভালবাসা, মায়া, মমতা, আত্মবিশ্বাসেও ছিল ঘাটতি। সততার, আলো ছিল অজ¯্র দূরে। একটু ভালবাসার স্পর্শ আর সমাজবদ্ধ শান্তিময় জীবন ছিল দূরন্ত ! গৌতম বুদ্ধ যুক্তির অনুশীলনে বিশ্বমানবের মধ্যে ত্যাগতিতিক্ষা, ক্ষমা, অহিংসা, শান্তি ও কল্যাণের বাণী ছড়িয়েছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুঁচাতে সাম্য-মৈত্রীর কথা বলেছেন।
