মহাপ্রতাপশালী মন্ত্রীকে রূধিবে কে?
মঞ্জুরুল আলম পান্না
সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে এ পর্যন্ত কত শত বা সহ¯্রজন মন্ত্রী হয়েছেন তা হিসেব করে বলাটা বেশ কষ্টসাধ্য বৈকি। মানুষ তাদের সহজে ভুলেও গেছেন। হাতে গোনা কয়েকজনকে হয়তো অনেকেই মনে রেখেছেন তাদের সততা আর দেশপ্রেমের কারণে। শুধু যে সৎ, যোগ্য আর দেশপ্রেমিক মন্ত্রীদেরই কেউ কেউ মনে রেখেছেন তা অবশ্য নয়। এর বাইরে যারা নিজ কর্মগুণে নিজেদেরকে মহাপরাক্রমশালী মনে করে বিতর্কিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন অনেক সাধনায় তাদের দু-চারজনকেও আমরা স্মরণে রেখেছি তা সে যেভাবেই হোক। এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারে এমন দু-একজন হয়তো এখনো রয়েছেন। এমনই একজন মন্ত্রীকে মানুষ খুব সহজেই চেনেন, তার বহুমুখী প্রতিভা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে যিনি নাক গলানো বা অসাধারণ যোগ্যতায় খবরদারি করেন। তিনি একাধারে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, শ্রমিক নেতা, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সড়ক মন্ত্রনালয় জিম্মি তার কাছে। তার প্রচ্ছন্ন প্রভাবে অনেক সময়ই কোনঠাসা হয়ে পড়ে শ্রম কিংবা শিল্প মন্ত্রনালয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা বলে কথা। তাই যে কোনো শ্রমিক সেক্টরই চলে তার হাতের ইশারাতেই। আন্তঃমন্ত্রনালয় সংক্রান্ত বৈঠকের অনেক সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে তারই খেয়াল খুশিতে।
পোশাক শ্রমিকদের মহাসমাবেশে তিনি হয়ে ওঠেন মধ্যমণি, তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের নেতৃত্বে থাকেন আমাদের মান্যবর সেই মন্ত্রী। অদক্ষ অযোগ্য পরিবহন শ্রমিকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোতে সাধারণ যাত্রীদের জীবনের যবনিকাপাত ঘটলেও অপরাধীদের টিকিটি ধরার ক্ষমতা রাষ্ট্র রাখে না সেই একই ব্যক্তির কারণে। ভাড়া বৃদ্ধির অপকৌশলে রাজধানীতে হঠাৎ হঠাৎ সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে দিনের পর দিন সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে রাখার নেপথ্যে থাকেন আমাদের সেই চেনা মহাপ্রতাপশালী মুখখানি। তারই ছত্রছায়ায় মালিক সমিতির অনৈতিক আবদারের মুখে দেশব্যাপী বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বিআরটিসির বাসও তুলে নিতে হয় একে একে। এই যখন অবস্থা তখন সড়ক ও সেতু মন্ত্রীর অসহায়ত্বও আর গোপন থাকে না। সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্তে সৃষ্ট নৈরাজ্য বন্ধ করতে না পেরে সচিবালয়ে জনাব ওবায়দুল কাদের বলতে বাধ্য হন, ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী।’
ওবায়দুল কাদের অসত্য বলেননি। তা না হলে কি আর খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশও উপেক্ষিত হয় অসীম ক্ষমতার অধিকারী সেই মন্ত্রীর কারণে? সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলবাহী জাহাজডুবির মতো মহাবিপর্যয়কর দুর্ঘটনার পরও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য থেকে যায়, সেই মাননীয় মন্ত্রীর বীরত্বের কাছে। বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে নদী, বন, প্রাণীকূল। শোনা যায়, তার এক কথাতেই না কি আবার বিরোধী দলের যে কোনো সমাবেশের দিনে রাজধানীর অভ্যন্তরে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় যাতে করে ওইসব সমাবেশে সংশ্লিষ্ট দলের নেতাকর্মীরা খুব সহজে পৌঁছাতে না পারে, যাকে অনেকে বলে সরকারি দলের হরতাল।
অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর আওয়ামী লীগ যখন একে একে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু এবং তার রায় কার্যকর করে চলেছে তখন ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন’ নামের নব্য এক সংগঠন সামনে নিয়ে এলেন আমাদের মাননীয় সেই মহান (!) নেতা। এতে বিব্রত বোধ করা শুরু করলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দশকের পর দশক ধরে রাজপথে সোচ্চার থাকা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো। এমনই তার ক্ষমতা যে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও হরেক রকমের অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তার অঙ্গুলি নির্দেশে। সেখানেও তাকে বাঁধা দেওয়ার কেউ থাকেন না।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তিনি যেই হোন তার মতো অসীম ক্ষমতার মানুষকে হয়তো সরকারের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। কিন্তু এমন দুই একজন ক্ষমতাবানের জন্যই কি আওয়ামী লীগের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী দল জনবিচ্ছিন্ন হতে খুব বেশি সময় লাগে? ইতিহাস কী বলে?
লেখক : সাংবাদিক
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ