
সর্বভূতে ইস্টদর্শন ভক্তি-সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থা
পূজন বিশ্বাস : বৈষ্ণব শৈব শাক্ত প্রমুখ ভক্তিপন্থী সাধক-মাত্রই সাধনার চরমাবস্থায় তাদের উপাস্য ঈশ্বর বা ইস্টকে সর্বভূতে দর্শন করে থাকেন। ভক্তিসাধনার অমৃতপ্রসূ ফলস্বরূপ রাগাত্মিকা বা পরাভক্তির এর পরম পরিণতি। এই অপার্থিব প্রেমের রাজ্যে এক এক মিলে দুই না হয়ে এক হয়, যেমন অংশ ও অংশী ভিন্নও বটে, আবার অভিন্নও বটে। প্রেমিক ভক্তের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে আপনাকে প্রেমাস্পদের মধ্যে বলে দিতে, তার মধ্যে নিমজ্জিত হতে, তার সত্তার সঙ্গে আপনার সত্তাকে একীভূত করতে, কিন্তু নিজ সত্তাকে হারিয়ে নয়। এজন্য প্রেমিক রাগাত্মিক প্রেমের সর্বোচ্চ অবস্থায় প্রেমাস্পদের সঙ্গে অংশ-অংশীর ন্যায় অভেদসুখ অনুভব করেন। বস্তুতঃ দ্বৈতভাব না থাকলে প্রেমাস্পদের সঙ্গে প্রেমিকের সম্বন্ধাশ্রিত রসানুভব সম্ভব হয় না। কারণ নির্বিশেষ অদ্বৈতরাজ্যে জ্ঞাতা জ্ঞেয় ও জ্ঞানের ভেদ বিলুপ্ত হয়। তখন কে রসানুভব করবে? এইজন্য অনুরাগী প্রেমিক ভক্তের মন স্বভাববশেই দ্বৈতরাজ্যে নেমে এসে প্রেমাস্পদের সঙ্গে সম্বন্ধাশ্রিত রস-সম্ভোগ করে। অদ্বৈতপন্থীর ন্যায় তারা পরতত্ত্বে মিশে একীভূত হন না। কেননা, তাদের সিদ্ধান্ত কারও মতে দ্বৈত, কারও মতে দ্বৈতাদ্বৈত এবং কারও মতে বিশিষ্টাদ্বৈত ইত্যাদি। তারা কেওই নির্বিশেষ অদ্বৈত মতো স্বীকার করেন না। তাদের মত-ভেদ, ভেদের মধ্যে অভেদ বা অভেদের মধ্যে ভেদ। এইজন্য তারা ভেদ ও অভেদের সুখ অনুভব করেন।
এই অবস্থায় ভক্তের সার্বজনীন প্রেম বা সর্বভূতে প্রেম স্বাভাবিক ভাবে উপস্থিত হয়ে থাকে। তার দৃষ্টিতে প্রেমাস্পদ ভগবান সমষ্টি বা অংশী এবং অংশরূপ বা ব্যষ্টিরূপ জীব ও জগৎ তারই অভিব্যক্তি। জীব ও জগৎ তাতে প্রলয়-কালে সূক্ষ্মরূপে থাকে শাক্তমতে নিত্যা শক্তিরূপে থাকে, সৃষ্টিকালে তা কার্যরূপ বা স্থূলরূপ প্রাপ্ত হয় মাত্র। অংশ-অংশী ভাব থাকায় তিনি এক হওয়াও বহু দেহে প্রবিষ্ট হইয়া রহিয়াছেন। এই জন্য প্রেমিক ভক্ত সর্বভূতে প্রেমাস্পদকে দর্শন করিয়া সকল রূপে তাকেই অভিব্যক্ত দেখিয়ে সকলকে আন্তরিক ভালবাসেন। তখন কোনো জীব আর তার নিকট কেবল জীবমাত্র থাকে না, সকলকেই তিনি প্রেমাস্পদের বিভিন্ন মূর্তিরূপে দর্শন করেন। এই কারণে সার্বজনীন প্রেম বা বিশ্বপ্রেম রাগাত্মিক প্রেমের চরম পরিণতি।
মানুষ শরীর বাক্য ও মন দ্বারা যা কিছু করে তাই কর্ম। জীবমাত্রই সকল অবস্থায় সর্বদা কোনো-না-কোনো কর্ম করে। ‘কর্মহীন হলে শরীরযাত্রাও নির্বাহিত হয় না।’ শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়াই জীবনের লক্ষণ। ‘কর্ম না করে কেউ ক্ষণকালও থাকতে পারে না।’ যখন মানুষ গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে, তখনো তার ভুক্তদ্রব্য-পরিপাক, রক্তসঞ্চালন এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রভৃতি দৈহিক ক্রিয়া চলতে থাকে। ‘নিঃশেষে সকল কর্ম ত্যাগ করা কোনো জীবের পক্ষে সম্ভব নয়।’ জীবনধারণ করতে হলে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সর্বদা সংগ্রাম প্রাণিগণের পক্ষে অপরিহার্য। জীব-জগতে জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর অবিরত সংগ্রাম চলিতেছে। এই সংগ্রামের অর্থই কর্ম।
জীবমাত্রেরই শারীরিক ও মানসিক কার্যাবলীর উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে, কোনো জীব কেবলমাত্র জীবন-রক্ষার জন্যই সকল কর্ম করে না। অধিকন্ত সে কর্মসহায়ে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে চেষ্টা করে তার সীমাবদ্ধ অপূর্ণ জীবনের গ-ি অতিক্রম করে এক অসীম ও পরিপূর্ণ জীবন লাভ করিতেÑ সকল অজ্ঞান অভাব ও দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে সকল চাওয়া ও সকল পাওয়ার অবসান ঘটাতেইÑ শরীর মন ইন্দ্রিয় ও প্রকৃতির দাসত্ব ত্যাগ করে সম্পূর্ণ স্বাধীন হইতেÑসকল বন্ধন দূরে সরিয়ে মুক্তিলাভ করতে। অতিক্ষুদ্র পরমাণু পরিমিত জীব হতে মানুষ পর্যন্ত সকল জীবই মুক্তিলাভের জন্য সর্বদা কর্ম করতেছে। মুক্তির অব্যক্ত প্রেরণায় সাধু সৎ কার্য করেন এবং অসাধু অসৎ কার্য করে। সর্ববন্ধন বিমুক্তিই সকল জীবের সকল কর্মের একমাত্র লক্ষ্য।
