
সহজ কথায় ধর্ম
আশালতা বৈদ্য
ধর্ম শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধৃ (ধরে রাখা, বহন করা, রক্ষণ করা) ধাতু থেকে। অর্থাৎ, যা কোনো কিছুকে ধরে রাখে বা রক্ষা করে অথবা যা ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব অসম্ভব তাইই হল ধর্ম। বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থের ধর্মালোচনা থেকে ধর্মের যে ধারণা পাওয়া যায়, তা হল; ন্যায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত, নৈতিক মূল্যবোধ, কর্তব্যনিষ্ঠতা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়, নীতির প্রতি অবিচল আস্থা ও ন্যায্যকর্ম সম্পাদন, অন্যের (মানুষ বা যে কোনো প্রাণীর) প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, জনকল্যাণে সংবেদনশীল ও সহযোগী হওয়া, প্রাকৃতিক গুনাগুণ বা চরিত্র, দায়িত্ব, কর্তব্য, সংবিধান ইত্যাদি। সোজা কথায়, ধর্ম হল এমন একটি পদ্ধতি যা, মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে ধরে রাখে, মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতির ঐকতান সৃষ্টি করে ও এই ঐক্যকে ধারণ করে। অর্থাৎ, আমরা যখন ধর্ম পালন করি, তখন আমরা আসলে বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মের সাথেই সহাবস্থান করি। অবস্থাভেদে বা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী ধর্মের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের পরিবর্তন ঘটে। আর এই বিশেষ কারণে, মাত্র এক লাইনে ধর্মের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। এই কারণেই এর (ধর্মের) অর্থের প্রায়োগিক ব্যাপকতা অনেক বিস্তৃত ও গভীর।
আসুন, আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করা যাক। প্রথমেই আসি ধর্মের মূল আভিধানিক অর্থ; অর্থাৎ যা দ্বারা কোনো কিছুকে ধারণ করা বোঝায়। যেমন, জলের ধর্ম তারল্য, বায়ুর ধর্ম বায়বীয়, কঠিন যে কোনো পদার্থের ধর্ম তার কাঠিন্য। এখন জল যদি তার তারল্য হারায়, তখন তা আর জল থাকবে না, অন্য কোনো পদার্থ; বরফ বা বাষ্পে পরিণত হতে পারে। একইভাবে, কঠিন পদার্থ তার কাঠিন্য, বায়ু তার বায়বীয়তা হারালে তা তাদের স্বাভাবিক সত্ত্বা হারিয়ে অন্য কোনো পদার্থে রূপান্তরিত হবে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি,
ধর্ম হল পদার্থের বা অন্য যে কোনো কিছুর এমন এক নিজস্ব গুণ, যা হারালে পদার্থ তার স্বাভাবিক অবস্থা হারায়, তার নিজস্বতা হারিয়ে হয় ধ্বংস প্রাপ্ত হয় নয়ত অন্য কোনো কিছুতে পরিণত হয়, যা তার স্বাভাবিক, গুণগত অবস্থা নয়।
এরপর আসি ধর্মের অন্য অর্থ যেমন; নীতি (বেদাদি ধর্মগ্রন্থ সমুহে এটি ধর্মের আরেক রুপ)। মানুষ পশু প্রজাতি হলেও, তার উন্নত মনন, দূরদৃষ্টি, চিন্তাভাবনার গতিশীলতা ও সাবলীলতার কারণে সে অন্যান্য প্রাণীদের মতো স্বভাবজাত নয়, বরং সে তার স্বতপ্রবৃত্তির বাইরে ও চিন্তা করতে পারে এবং নিজ আদিম প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই দারুন ক্ষমতার জন্যই সে আর সব প্রাণী থেকে আলাদা।
একই কারণে যে বন্য প্রাণীর মতো স্বভাবজাত মানসিকতা নিয়ে চলতে পারে না, বরং তার সমস্ত নিজস্ব কার্যকারণের আদ্যোপান্ত সে জানতে চায় ও তার সমর্থন চায়। আর এই কার্যকারণের পক্ষে সমর্থন যোগাতে সে নীতি আশ্রয়ী হয়, জীবনে চলার পথে নীতি-অনীতি, সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়, ঔচিত্য-অনোচিত্য প্রভৃতি যাচাই করে এবং এই যাচাইের সুবিধার্থে নৈতিক কর্মপন্থার খোঁজ করে। একজন ব্যাক্তি তার জীবনের জন্য এমন কিছু নীতির খোঁজ করেন বা এমন নীতি নিয়ে চলেন, যা তাকে বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কের পর্যায়ে স্বচ্ছন্দ করে তোলে, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে একটি অর্থপূর্ণ, স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ জীবনযাপনে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঘাত প্রতিঘাত এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে, শুধু তাই নয়, বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তার কর্তব্যকর্ম স্থির করতে ও সাহায্য করে। এরকম নীতি যে কোনো ব্যাক্তি বা সমষ্টি বা সামাজিক চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। এই উপাদান না থাকলে বা নষ্ট হলে, ব্যাক্তি বা সমাজের কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই থাকে না। অনেকটা চরিত্রহীন, হীনমন্য, বিবেকহীন, বোধহীন পরজীবী ক্লীবে পরিণত হয়। এই ধরনের ব্যাক্তি বা সমাজের ধ্বংসই একমাত্র নিয়তি। এক্ষেত্রে, নীতিই ব্যক্তি বা সমাজের ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত। যা থাকলে স্বীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া যায় আর না থাকলে নিজ গুনাগুণ রহিত হয়ে অপরের মুখাপেক্ষী হতে হয় এবং স্বীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
অর্থাৎ, আবারও ধর্মহীনতাই বিলুপ্তির কারণ।
এরপর, ধর্মের আরেকটি অর্থের কথা বলতে হয়, যা হল ন্যায়। যারা মহাভারত পড়েছেন, তারা জানেন, কৌরব ও পা-বদের মধ্যেকার যুদ্ধটি সংগঠিত হবার মূল কারণ ছিল ন্যায়। পাশাখেলায় পরাজিত হবার শাস্তি হিসেবে পা-বদের ১২ বছর বনবাস ও ১ বছর অজ্ঞাত বাস করতে হয়। শর্ত ছিল, শাস্তিভোগের পর পা-বরা তাদের রাজ্য ও সম্পদ ফিরে পাবে। কিন্তু, কৌরবরা শর্তভঙ্গ করে ও পা-বদের রাজ্য ফেরত দিতে অস্বীকার করে, উল্টো যুদ্ধের হুমকি দেয়।
প্রাপ্য ফেরত পাওয়ার সমস্ত তৎপরতা এবং কূটনৈতিকতা (সাম, দান, ভেদ) ব্যর্থ হলে পা-বরা ‘কুরুক্ষেত্রে’ যুদ্ধে (দ-নীতি) অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধ ছিল ন্যায্য প্রাপ্তির যুদ্ধ অর্থাৎ ন্যায়ের যুদ্ধ। আর এই ন্যায়ের যুদ্ধকেই মহাভারতে বলা হয়েছে ধর্মযুদ্ধ। এখানে, ন্যায় ও ধর্ম সমার্থক। দেখুন, যে কাউকেই সমাজে বসবাস করতে হলে, তাকে আর দশজনের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে হয়। মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন তৈরি হয় তেমনি আবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংঘাত ও তৈরি হয়। ঠিক এই জায়গাটাতেই ন্যায়ের প্রশ্ন আসে। আমি যদি অপর ব্যাক্তির সাথে অন্যায় আচরণ করি, তবে তারও আমার প্রতি অন্যায় আচরনের অধিকার আছে, কারণ, আমি আগে অন্যায় আচরণ করে তাকে সে অধিকার দিয়েছি। এটা আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন ও অধিকারের প্রশ্ন। দুই বা ততোধিক ব্যাক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যদি ন্যায় অনুপস্থিত হয়, তবে সম্পর্কের মধ্যে অন্যায় আসবে, একপাক্ষিকতা আসবে, বঞ্চনা আসবে, বৈষম্য আসবে। এই ধরনের সম্পর্কের মধ্যে কোনো শ্রদ্ধাবোধ বা ভালবাসা তৈরি হয়না বরং শঠতা ও প্রতারনা তৈরি হয়।
পরিণামে তা একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্কের অন্তরায় হয়, সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ ও জাতি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে। অরাজকতা তৈরি হয়, মাৎস্যন্যায় তৈরি হয়, দুর্বলের উপর সবলের উৎপাত বৃদ্ধি পায়, পরিবার ও সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ে এবং এর ফল অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস। কুরুক্ষেত্রে কৌরবদের ধ্বংস হয়েছিল। আর বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
অতএব আবার দেখতে পাচ্ছি, ন্যায়স্বরূপ ধর্মের অনুপস্থিতি এবং নিশ্চিত ধ্বংস।
ধর্ম হল কর্তব্যকর্মের এমন এক নীতিমালা, যা এক মহাজাগতিক শৃঙ্খলার নির্দেশক, যা বৈষয়িক উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞ্যানকে একীভূত করে, মানুষে মানুষে এবং মানুষ ও বৃহত্তর প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের ঐকতান সৃষ্টি করে, যার সচেতন চর্চায় মোক্ষলাভের (জন্ম ও মৃত্যুর চক্র হতে মুক্তি) পথ সুগম হয়।
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম বলতে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের নীতিকেই বোঝায়, যে নীতির আলোকে মানুষ তার আর্থ ও কাম চরিতার্থ করবে, যে নীতিতে মানুষ তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বৃহত্তর মানবজাতি ও বৃহত্তর প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে, তাদের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে, যে নীতির সচেতন চর্চায় তার সুপ্ত মানবিক গুনগুলোকে সুষমাম-িত করে তুলবে এবং ধাপে ধাপে তার আধ্যাত্মিক সত্তাকে উপলব্ধি করবে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার পার্থক্য দুরীভুত হবে। লেখক : সম্মানিত ট্রাস্টী হিন্দু ধর্মীয় কল্যান ট্রাস্ট
