
বুদ্ধের দর্শনের মৌলিকতা
উপল বড়–য়া : বৌদ্ধ দর্শনের মৌলিক রূপ ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ ( ক্ষণিকবাদ) বৈপ্লবিক পরিবর্তনকারী। জগৎ, সমাজ, মানুষ সকলকে এই ক্ষণবাদ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল ঘোষণা করেছে, এবং যা আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না। ‘তে হি নো দিবসা গতাঃ’Ñসেই আমাদের দিনগুলো চলে গেছে। যা গেছে তার চিন্তা ছেড়ে পরিবর্তনের অনুসারে নিজের ব্যবহার, নিজের সমাজের পরিবর্তনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা দরকার। বুদ্ধ গভীর হতে গভীরতর নিজ দার্শনিক বিচার বা ‘ধর্মকে ভেলার ন্যায় কেবল তা প্রয়োজনসাধনের নিমিত্ত বলেছেন। প্রয়োজনসধানের পর সেই ভেলাকে বহন করার নিন্দা করেছেন। তবুও এই বৈপ্লবিক পরিবর্তকারী দর্শন নিজের ভেতর হতে সেসব তত্ত্বকে (ধর্ম) দূরে সরিয়ে দিতে পারল না। যে-তত্ত্বগুলো সমাজের প্রগতিকে অবরুদ্ধ করার কাজ করছিল। যদিও বুদ্ধ নিত্য আত্মা স্বীকার করেন নি, নিত্য আত্মার এক দেহ হতে দেহান্তর সংক্রমণরূপে পুনর্জন্ম মানেন নি তবুও তিনি ভিন্নরূপে পরলোক ও পুনর্জন্ম স্বীকার করেছিলেন। যেমন এই শরীরে‘জীবন’বিচ্ছিন্নপ্রবাহ (নষ্ট- উৎপত্তির) রূপে এক প্রকারে একত্ব স্থাপন করেছে,সে প্রকারেই তা দেহান্তরে প্রচলিত থাকবে। পুনর্জন্মের দার্শনিক ভিত্তি আরো দৃঢ়তর করতে গিয়ে বুদ্ধ পুনর্জন্মের পুনর্জন্ম প্রতিসসিন্ধরূপে ( বা ঘোষণা) করেছেন- অর্থাৎ নাশ ও উৎপত্তির সন্ধি (বা শৃঙ্খলা) দ্বারা যেমন জীবনপ্রবাহ এই শরীরে চালু রয়েছে, সেরূপেই বর্তমান শরীর তার প্রতিসন্ধি (বা সংযোগ) হয়ে থাকে। অবিকারী নিরেট আত্মাতে পূর্বংস্কারসমূহ রাখার স্থান নেই, কিন্তু ক্ষণপরিবর্তনশীল তরল বিজ্ঞানে ( বা জীবনে) আত্মার বাসনা সংস্কাররূপে আপনার অঙ্গীভূত হয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। সৃষ্টির ব্যাখার নিমিত্ত ক্ষণিকতাই পর্যাপ্ত; কিন্তুুু ঈশ্বরের কাজ ছিল সংসারের ব্যবস্থা ও সমাজের শৃঙ্খলা (বা শোষিতের বিদ্রোহ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা) চিরস্থায়ী রাখা। গমনা-গমন (বা জন্ম-মৃত্যু) ধনী- নির্ধন ভেদ সেই কর্মের কারণেই হয়,যার কর্তা কোনো তুমি সময়ে তুমি নিজে ছিলে, যদিও আজ ঐ কর্ম তোমার পক্ষে হস্তচ্যুত তীর সদৃশ। ‘বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদের এই রূপ দেখে যেখানে সে – সময়কার প্রভু সম্প্রদায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল, সেখানে তিনি প্রতিসন্ধি ও কর্মের সিদ্ধান্তকে সর্ম্পণ নিঃসন্ধিগ¦ভাবে প্রচার করলেন। এ কারণে আমরা বড় বড় রাজা, সম্রাট , বণিক ও মহাজনগণকে বুদ্ধের পতাকাতলে সম্মিলিত হতে দেখি। ভারতবষের বাইরে শ্রীলস্কা, ব্রক্ষদেশ, চীন, জাপান, তিব্বত প্রভৃতি দেশেও তাঁর ধর্ম বিস্তারে রাজারাই সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন যে, সামাজিক বিদ্রোহের উদ্দেশ্যে এই ধর্ম প্রচারিত নয়,ববং সমাজের স্থিতিস্থাপকতায় পক্ষে খুব সহায়ক হবে। জাতি ও দেশের সীমা লঙ্ঘন করে বুদ্ধের চিন্তাধারা রাজ্যবিস্তারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সমাজের আর্থিক বৈষম্য অক্ষুণœ রেখেই বুদ্ধ বর্ণব্যবস্থা ও জাতীয় উচ্চ-নীচ ভাব অপসাণের চেষ্টা করেছিলেন। এতে সত্যকার বৈষম্য অপসৃত হয় নি, কিন্তুু নিম্ন শ্রেণীর দিক দিয়ে দেখতে গেলে বৌদ্ধধর্মের শাসকবর্গের প্রতিনিধির মধ্যস্থ সদৃশ ছিল; শ্রেণীর মৌলিক স্বার্থকে ক্ষুণœ না করেই তা নিজকে ন্যায়পক্ষপাতী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল।’’ (‘বৌদ্ধ দর্শন’- রাহুল সাংকৃত্যায়ন)।
