বৌদ্ধিক রহস্য ও তার উৎপত্তি স্থল
সুদীপ মিত্র : বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে জানতে গেলে প্রথমে হিন্দুধমর্মের মুলপর্বের কিছু কথা জানতে হবে। কারণ বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের একটি অংশবিশেষ। প্রাচীন হিন্দুধর্মে (রামায়ন ও মহাভারতের পূর্ববর্তী সময় যেটাকে হিন্দুধর্মে সত্যযুগ বলে) কোন দেবদেবীর বস্তুভিত্তিক অস্তিত্ব ছিল না। তখন ছিল বেদ ও বেদান্ত। মুলত হিন্দু ছিল একটি দর্শন যার অর্থ এই চরাচর জগতের নিয়ন্ত্রণ ও তার কার্যকারণ উদ্দেশ্য বিধেয় সম্মন্ধে জানা ও তার দ্বারা মানব জাতির অগ্রগতি করা। এই দর্শনকে জানার জন্য যেসব দার্শনিকরা নিদারুণ পরিশ্রম করেছিলেন এবং সেই নিয়ন্ত্রকের(যাকে আমরা আল্লাহ, গড, ঈশ্বর, ফাদার, ভগমান বাপরমেশ্বর ইত্যাদি বলে ডাকি) সম্মন্ধে অংশবিশেষ একেজন একেকভাবে জেনেছিলেন। এই পরমজ্ঞান সিদ্ধ মানুষদের আমরা ঋষি ও মুনি বলে থাকি এবং এদের লব্ধজ্ঞানের সম্মিলিতভাবে সংকলনকে বেদান্ত বলা হয়। এবং এই দুষ্প্রাপ্য জ্ঞানকে ব্রহ্মজ্ঞান বলা হয়। বদ্ মানে সংস্কৃত ভাষায় যিনি জেনেছেন অর্থাৎ সেই ঋষিমুনি স্বরূপ ব্রহ্মজ্ঞানি, এবং বেদ মানে মানবকল্যানের নিমিত্তে যাহা জেনেছেন, তাই বেদ হচ্ছে সেই জ্ঞান যাতে মানব কল্যানার্থে সামাজিক (সামবেদ), বস্তু রসায়ন ও আয়ুর্বেদ (ঋকবেদ) গনিতসহ জ্যোতর্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র ,গননাশাস্ত্র (যদুবেদ), ব্রজ্ঞানকে জানা এবং উক্ত মুনিঋষিরা কাকে ও কিভাবে জেনেছেন(অথর্ব বা বেদান্তপর্ব) এইমোট চারটি পর্যায় নিয়ে হিন্দুধর্মের মুলবিকাশ । এই সময় হিন্দুদের ব্রক্ষসাধনার মুলপ্রক্রিয়া ছিল কঠোর সাধনা ও পরমেশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত যাহা কিছু তাহা অগ্নিতে আহুত করা হত কারন ওনারা মনে করতেন যে অগ্নি দ্বারাই প্রথম মানুষের সভ্যতার ও জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে, তাই অগ্নি পরমেশ্বরের প্রথম আনুগত্য ও মানুষদের প্রথম গুরুমুখ । এই অগ্নিদেবের বহু বহু রূপ যেমন দেহের মধ্যে যে জ্ঞানের জ্যোতি, যৌবনের যে জ্বালা, ক্ষুদার জ্বালা, ক্রোধ, হিংসা, প্রভৃতি হচ্ছে এই অগ্নিদেবের মাহাত্মে । বলা হয় নারায়ণ (পরমেশ্বরের পালন স্বরূপ চৈতন্য) তিন লোকের মালিক যথা (১০) ভূলোক-পৃথিবীর সমস্থ কিছ ু(২) গোলক-মহাবিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সমস্থ কিছু(৩) দ্যুলোক-শরীর মন আত্মার মালিক এমন এক বৈদুর্য্যময় দ্যুতি যাহা হতে সমস্থ বিশুদ্ধ জ্ঞান ও স্বত্তার জন্ম । মহাভারতের যুগে যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবার সনাতন হিন্দুধর্মের মুলত্বত্ত্বকে তুলে ধরলেন। গীতাতে তার স্ববিশেষ ব্যাখ্যা করলেন। সেখানে নিরাকার ব্রহ্মের নির্গুণ সত্তা কিভাবে স্বগুণ ও সাকার জগৎকে বিকাশ করল তার স্ববিশেষ ব্যাখ্যা এবং মানুষের মধ্যে কিভাবে সেই ব্রহ্মস্বত্তার অবস্থান ও তাকে কোন কোন যোগবলা জানা যাবে তার স্ববিশেষ চমৎকৃত ব্যাখ্যা করলেন। দেহের এই দ্যুতিস্বরূপ আত্মাকে প্রকৃতভাবে জানাকেই দেহের স্থুল সত্তার মাঝে সুক্ষ্ম সত্তা বা দেহের মধ্য দেহির প্রাপ্তি বলা হয়। কিন্তু কালক্রমে এই মুল দেহতত্ত্ব ভেদকারি জ্ঞান বিশুদ্ধ সাধনা পদ্ধতির অভাবে প্রায় অবলুপ্ত হতে চলল ঠিক এই সময় এলেন আর এক অবতার ভগবান বুদ্ধদেব । বৌদ্ধধর্মের জনক অবতার পুরুষ বুদ্ধদেব যার সংসারিক নাম ছিল সিদ্ধার্থ তাঁর আগমন হয়েছিল মহাভারতের যুগ দ্বাপরের ঠিক আড়াই হাজার বছর পর এবং আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে, কিন্তু বুদ্ধের বৌদ্ধিক সাধনার মুল তত্ত্ব হচ্ছে দেহ, মন, ভাব ও ক্রিয়ার বৌদ্ধিক সমন্বয়। বৌদ্ধিক শব্দের সন্ধি হল বোধ+ইক= বৌদ্ধিক এখানে বোধ মানে বুদ্ধ ও বিবেকের জাগ্রত অবস্থা এবং ইক মানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ যখন কারো বুদ্ধি ও বিবেকের জাগ্রতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়ে থাকে। এবং সেটাকে জাগাবার জন্য দেহ মন ও ভাবের সমন্বয় পদ্ধতিকে বৌদ্ধিক পদ্ধতি বলা হয় এর দ্বারা সাধক সেই দ্যুতিরূপি পরম চৈতন্যর অতি সুক্ষè সত্তাকে দেহরূপী স্থুল সত্তার মধ্যেই লাভ করে এবং এই দ্যুতির প্রভাবে মন শরীর আত্মা ভাব ও বোধবুদ্ধি দেহের এই পাঁচ মহাত্বত্ত্বের পুর্ন বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হয় এবং পরমার্থের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মানব কল্যাণের জন্য অমর কর্ম করতে পারে এই পরম অবস্থা যখন প্রাপ্ত হয়ে তখন তাকে বোধিসত্ব অবস্থা বলা হয় । তিনি যে আধ্যাত্মিক দর্শনকে একটি বৃহৎ সামাজিক স্তরে সফলভাবে প্রয়োগ করতে সফল হয়েছিলেন সেটা কিন্তু নতুন কিছু ছিল না কারণ সেটার শাস্ত্রভিত্তিক উল্লেখ মহাভারতে ছিল কিন্তু নতুনত্ব এটাই ছিল যে মহাভারতের পরবর্তি যুগে হিন্দু সাধনার বৈদিকরূপ মুলত তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল (১)বৈষ্ণব (২)শাক্ত (৩) বৌদ্ধিক ।
মহাভারতের বৌদ্ধিক রহস্য-হিন্দুধর্মকে পুরো বিশ্বের দরবারে অন্যান্য ধর্মের সাধক ও দার্শনিকগণ রহস্যভেদী ধর্ম বলে আখ্যা দিয়েছেন যার সিংহভাগ কারণই হচ্ছে এই মহাভারত। যদিও মহাভারতের ছত্রে ছত্রে সাধনতত্ত্বের রহস্যে ভরা কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে সংক্ষিপ্তে আমি বৌদ্ধিক রহস্যের কথা বলব।(১)মহাভারতের সমাস অর্থ হয় মহা ভার নিয়ে রত যিনি, সম্ভবত এটা তৃতিয় বহুব্রীহি সমাস হতে পারে। এর অর্থ এই দেহরূপী মহাভারকে ধারন করে আছেন যিনি। (২)কুরুক্ষেত্র এর সমাস অর্থ নিরন্তর কর্মশীল ক্ষেত্র মানে জমি অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু কর্ম বিনা কেহই রইতে পারে না তাই জীবনের এই জন্ম হইতে মৃত্যু অব্দি বিস্তৃত ক্ষেত্রকে কুরুক্ষেত্র বলা হয় যেখানে মানুষকে বাঁচার লড়াইতে হয় ধর্ম অথবা অধর্মের রাস্তায? চলতে হয়। (৩)শ্রীকৃষ্ণ এর সমাস হচ্ছে শ্রীকে কর্ষণ করেন যিনি অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মান্ড সহ জগৎ সংসার ও এই দেহভান্ডের সকল শ্রী অর্থাৎ রূপকে যিনি কর্ষন অর্থাৎ টেনে ধরে রেখেছেন। (৪)পঞ্চপান্ডব এর সমাস হল পাঁচ গুনের সমাহারে যে অবয়ব অর্থাৎ শরীর, অর্থাৎ বিবেকবোধ,আত্মশক্তি,মানষিক একাগ্রতা,ধৈর্য ও উদ্দমতা এই মহাপঞ্চগুন। (৫) কৌরব এর সমাস কু রবে নিনাদিত যে অবয়ব অর্থাৎ সদা কু চিন্তায় আক্রান্ত যে অবয়ব বা শরীর।